ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কে এই ক্যাসিনো লোকমান?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:৪২ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

একটা সময় খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখর থাকতো রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ক্লাবটিতে রাত-দিন আড্ডায় মশগুল থাকতেন সাবেক খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা। সেই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। এক লোকমানই ক্লাবটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে বলে জানান ক্লাবটির সাবেক এক পরিচালক। 

জানা গেছে, কর্মকর্তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত মোহামেডান ক্লাবে খেলার বদলে জায়গা করে নিয়েছে ক্যাসিনোর বোর্ড, মাদকসহ অবৈধ অনেককিছুই। ক্লাবটির ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ স্থানীয় যুবলীগের সঙ্গে যোগসাজশে ক্লাবটিতে এসব করছে।

কিন্তু কে এই লোকমান হোসেন? কিভাবে আসলেন মোহামেডান ক্লাবের দায়ীত্বে? বিএনপি ঘরানার সংগঠক হয়েও কিভাবে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবিতে? 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার পুরো নাম লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। বাড়ি নোয়াখালীতে। এক সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা দেখভাল করার সময়ই বিএনপির শীর্ষ অনেক নেতার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে লোকমানের। 

১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখনই ব্রাদার্স ইউনিয়নের সংগঠক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে লোকমান হোসেনের। বিএনপির ওই সময়ে মোহামেডানের হাল ধরেন মোসাদ্দেক হোসেন ফালু। তার হাত ধরেই মোহামেডানে প্রবেশ করেন লোকমান হোসেন। চতুর লোকমান ধীরে ধীরে ফালুর সুনজরে এসে বাগিয়ে নেন অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদকের পদ। পরবর্তীতে ফালুই তাকে বসান ক্লাবটির সাধারণ সস্পাদকের চেয়ারে। ক্লাবটিকে পুঁজি করেই ধীরে ধীরে বিত্তবৈভবের মালিক হতে থাকেন লোকমান। 

পরবর্তীতে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একটি অংশের জায়গা এক ওষুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ আছে এই লোকমানের। ক্লাবটির স্থায়ী সদস্য করার নামে অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। মোহামেডানে যে ক্যাসিনো বসানো হয়েছে তার জন্যও লোকমানকে দায়ী করছেন ক্লাবের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, এসব অবৈধ অর্থ দিয়েই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন লোকমান হোসেন। গত ১৪-১৫ মাস ধরে ক্যাসিনো চলেছে মোহামেডানে। এ সময়ে ক্লাব ফান্ডে গেছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। আর বড় অঙ্কের অর্থ লোকমানের পকেটেই গেছে বলে জানা গেছে। 

মোহামেডান ক্লাবের দৈনিক আয়-ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ৩১ জানুয়ারি ক্লাবের আয় ছিল ৫১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দিনটিতে ব্যয় হয় ৩৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সবাইকে ‘ভাগ’ দিয়ে তাদের লাভ হয় ১৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। জুয়াসহ অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর সুযোগ করে দিয়ে মোহামেডান ক্লাব থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পেত পুলিশ। ক্লাবের দৈনিক আয়-ব্যয়ের হিসাবপত্রে বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। 

হিসাবপত্রে আরও রয়েছে ‘বিজনেস প্রমোশন’  নামে একটি খাত। যে খাতে প্রতিদিন খরচ হতো ৫ লাখ টাকা। যা পুলিশসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা পেতেন বলে ক্লাবের কয়েকজন কর্মচারী ও জুয়াড়িরা জানিয়েছেন।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালা বদলে মোসাদ্দেক হোসেন ফালু ক্লাব ছাড়লেও টিকে যান লোকমান হোসেন। মূলত তখন থেকেই শুরু হয় ঐতিয্যবাহী ক্লাবটির পতন। 

২০০১ সালে বিএনপি ফের ক্ষমতায় আসলে রূপ পাল্টে যায় লোকমানের। আওয়ামী ঘরানার অনেককেই ক্লাব ছাড়া করেন লোকমান। এসময় ফের ক্লাবে ফেরেন মোসাদ্দেক হোসেন ফালু। ফালুর সঙ্গে মিলে বিএনপির সকল সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেন লোকমান। খেলাধুলাকে প্রাধান্য না দিয়ে ক্লাবটিকে আর কিভাবে ব্যবহার করা যায় সেদিকেই যেন বেশি দৃষ্টি ছিল তার। যে কারণে ২০০২ সালের ঢাকা প্রিমিয়ার লীগের শিরোপাই ছিল ফুটবলে মোহামেডানের সর্বশেষ বড় সাফল্য। 

২০০৭ সাল থেকে পেশাদার ফুটবল লীগ শুরু হওয়ার পর প্রতিযোগিতায় আর একবারও সাফল্য পায়নি ক্লাবটি। পেশাদার লীগে ১১টি আসর অতিক্রান্ত হলেও শিরোপাশূন্য থাকে স্বাধীনতার পর ঢাকা লীগের ১২ বারের চ্যাম্পিয়নরা। 

ক্রিকেটেও অবস্থা শোচনীয়। ঢাকা লীগে মোহামেডান সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০৯-১০ মৌসুমে। টাকার অভাব দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাবা ও হ্যান্ডবলে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে মোহামেডান। 

দীর্ঘ এ সময়ে ক্ষমতার পালা বদল হয়। ২০১০ সালে ফালুকে দিয়ে মোহামেডানকে লিমিটেড কোম্পানি করিয়েছেন লোকমান হোসেন। এমনকি ক্লাবের সম্পত্তি দখলের নেশায় সেই ফালুকেই ক্লাব ছাড়া করেন লোকমান। মাঝে কুতুবউদ্দিন আহম্মেদ মোহামেডানের হাল ধরলেও বেশিদিন টিকতে পারেননি। কুতুবউদ্দিনের বিদায়ের পর সালাম মুশের্দী, বাদল রায়দেরও ক্লাব ছাড়া করেন লোকমান। 

২০১২ সালে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমকে সভাপতি করেন লোকমান হোসেন। পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে পুরো ক্লাবই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। শুরুতে ওবায়দুল করিম ক্লাবে প্রচুর অর্থ দিলেও ঠিকমতো তার হিসাব না পেয়ে ক্লাবে আসা ছেড়ে দেন তিনি। এসময়ে নিজেদের লোক দিয়ে মামলা করে নির্বাচনও আটকে রাখেন লোকমান। 

বর্তমান কমিটির মেয়াদ পাঁচ বছর আগে শেষ হলেও কোন খবর নেই নির্বাচনের। বোর্ড সভা হয় না চার বছর ধরে। অথচ এই ক্লাবের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেই ক্রিকেট বোর্ডের প্রভাবশালী পরিচালক হয়েছেন লোকমান হোসেন। বিসিবির ক্ষমতাশালী এক কর্তার বন্ধু হওয়াতে বোর্ডে সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা পান তিনি। বিবিসির বর্তমান কমিটিতে লোকমান আছেন ফ্যাসিলিটি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে। বিসিবির স্টেডিয়াম ও অবকাঠামোগত উন্নয়নেই কাজ করে থাকে এই কমিটি। 

এর আগে ২০১৩ সালে বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটির প্রধান ছিলেন লোকমান। যা নিয়ে হয় ব্যাপক সমালোচনা। ক্রিকেট বোদ্ধারা মনে করেন, এ পদে একজন টেকনিক্যাল জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল। যার স্বচ্ছ ধারণা থাকবে উইকেট-আউটফিল্ড সম্পর্কে। 

তবে এ দায়িত্ব দীর্ঘ দিন ধরে রাখতে পারেননি লোকমান। তার সময় মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মাঠ নিয়ে ওঠে নানা প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ভেন্যুতে তার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগও আছে। এর মধ্যে, লোকমান হোসেনের ভাগিনা পরিচয় দিয়ে থাকেন কক্সবাজার স্টেডিয়ামের ভেন্যু কো-অর্ডিনেটর বাহার। শুধু তাই নয়, নিজেকে ভেন্যু ম্যানেজার হিসেবেও পরিচয় দেন বাহার।  

অন্যদিকে, বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তার কাছের লোক হওয়ায় বোর্ডেও নানাভাবে নিজের ক্ষমতা দেখাচ্ছেন লোকমান। এই লোকমানের কারণেই ঐতিহ্য হারিয়েছে মোহামেডান। হয়ে গেছে ফ্যাঁকাসে, ধূসর।

এনএস/