ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

রাষ্ট্রের চাইতে কারো ক্ষমতা বেশি নয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৪০ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ১১:৪১ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)

টাকা ও ক্ষমতার দম্ভে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন সেই মানুষ নিজেকে ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পায় না। অন্য মানুষকে তারা মানুষ মনে করে না এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে তোয়াক্কা করে না। কারণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতিনিধিরাও ভোজের উচ্ছিষ্ট প্রাপ্তিতে কখনো কখনো তাদের হুকুমের দাসে পরিণত হয়। তখন ব্যক্তি ও রাষ্ট্র ক্ষমতাকে তারা একাকার করে ফেলে। রাষ্ট্রের সহজাত ক্ষমতাকে তারা আলাদা করে দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারে না। ভাবে সবাই ও সবকিছুই তার পদানত। কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না।

সম্প্রতি ক্যাসিনো ও জুয়ার আসরের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান শুরুর প্রথম দিনে এক নেতার কথা শুনে এরকমই মনে হয়েছিল। দুই যুবলীগ নেতার গ্রেফতার এবং কোটি কোটি অবৈধ টাকা উদ্ধারের চাঞ্চল্যকর খবরে নেতা গর্জে উঠলেন এই বলে যে, অভিযানের আগে তাকে কেন জানানো হলো না। একবারও ভাবলেন না রাষ্ট্র পরিচালনার ভেতরে তিনি কে? তাই অন্ধের মতো বলে উঠলেন তিনিও সবাইকে দেখে নিবেন। দাবি জানালেন, পুলিশ ও র‌্যাবকেও গ্রেফতার করতে হবে। কিন্তু যখন দেখলেন সারাদেশের মানুষ দলমত নির্বিশেষে এই অভিযানকে স্বাগত জানাচ্ছে তখন ওই নেতা সুর নরম করলেন। কিছু দুর্বৃত্ত ছাড়া বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ উৎফুল্ল ও আনন্দিত। 

বিগত কয়েক দশকের মধ্যে অন্য কোনো ইস্যুকে ঘিরে এতবড় জাতীয় ঐক্য বাংলাদেশে আর কখনো দেখা যায়নি। একটি রাষ্ট্রের শক্তির মৌলিক উৎস তিনটি। সংবিধান, আইন ও জনগণ। এর মধ্যে জনগণের শক্তিই সুপ্রিম। যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে সংবিধান ও আইনের রক্ষক ও প্রয়োগকারীরা যখন নিজেরাই ভক্ষক ও অপপ্রয়োগকারী হয়েছেন তখন বৃহত্তর জনগণই আবার জেগে উঠেছে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মহানায়ক শেখ মুজিবের মেয়ে। ছোটবেলা থেকে জনগণের সেই শক্তি তিনি দেখেছেন। আবার নিজের মহাকঠিন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বাঁকে বাঁকে সেটি উপলব্ধি করেছেন। 

রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনকে পদদলিত করে পাকিস্তানের লৌহ মানব আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিলেন। তখন বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষকগণ শঙ্কিত ছিলেন। হয়তো আইয়ুব খান তার সংকল্পে অটুট থাকবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের ক্ষমতার জোরে বঙ্গবন্ধুকে বিনাশর্তে বেকসুর খালাস দিতে আইয়ুব খান বাধ্য হন। এটা তো গেল পাকিস্তান আমলের কথা। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধান ও আইনের একমাত্র মালিক বনে গেলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার কূটকৌশলের অংশ হিসেবে সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের প্রবর্তন করলেন। তাতে রাষ্ট্র ও ধর্ম, দুটোরই সর্বনাশ হলো। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ বড়ই সেয়ানা। কারো ভণ্ডামি ধরতে সময় লাগে না। জনশক্তির ধাক্কায় এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলেন।

উল্লিখিত দুটি ঘটনার সময় জনতার কাতারে থেকে সবকিছু দেখেছেন শেখ হাসিনা। তারপর ২০০৭-২০০৮ সালে জনক্ষমতার নতুন পরীক্ষা এলো। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন ও তাদের মন্ত্রদাতাদের ভণ্ডামি বুঝতে পারেননি। শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন। ঔদ্ধত্য সব উপদেষ্টারা নিজেদের মতো করে সংবিধান ও আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করলেন। কিছুদিন যেতেই সেয়ানা বাঙালি বুঝে গেল এদের মতলব ভালো না। এরা দেখি পরাশক্তির কাছে রাষ্ট্রকে বিক্রি করে দিতে চায়। জনগণ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াল। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার বাসনা নিয়ে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরের মাথায় বিদায় নিল। তারপর জনগণের বিশাল সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলেন। ১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেছেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং জনগণ এক ও অভিন্ন। একটিকে বাদ দিলে অন্যটি থাকে না।

তাই জনআকাঙ্ক্ষা ও গণমানুষের পালস শেখ হাসিনার চাইতে কেউ ভালো বোঝে না। দীর্ঘদিন দলের কর্ণধার হিসেবে তিনি উপলব্ধি করেছেন ১৯৭৫ সালের পর সামরিক শাসকদের প্রবর্তিত দুর্বৃত্তায়ন ও কলুষিত রাজনীতি আওয়ামী লীগের একাংশের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। এদের কবল থেকে দলকে মুক্ত করতে না পারলে পিতার স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। 

অন্যদিকে দুই সামরিক শাসক ও তাদের প্রতিভুগণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রের সর্বত্রে জঞ্জাল সৃষ্টি করে গেছে। জাতির পিতার স্বঘোষিত খুনিদের ঔদ্ধত্য আচরণ, যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠান, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে দুর্নীতিতে রাষ্ট্র পর পর চারবার বিশ্বের এক নম্বর, রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, যার ফলে দেখা যায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থার সর্বোচ্চ কর্মকর্তাগণ বিশাল অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, একাত্তরের পরাজিত গোষ্ঠি সশস্ত্র জঙ্গি সন্ত্রাসীর বিশাল বহর নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছে। এতসব জঞ্জাল পরিষ্কার করে পিতার স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই প্রবল শত্রুপক্ষ দণ্ডায়মান। কিভাবে এগোবেন। কোনটা আগে কোনটা পরে, নাকি সব একসঙ্গে ধরবেন। বিগ ডিলেম, বিগ কয়োশ্চেন। বিশাল কন্ট্রাডিকশন। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ভাবতে গেলে মাথায় কিছু আসে না। এমতাবস্থায় গত দশ বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন, তা যে কোনো বিচারে অভাবনীয় এবং বিস্ময়কর। এই অর্জনের পথে প্রধানমন্ত্রীকে বহুফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হয়েছে, সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তিনি একেক করে সব জায়গায় হাত দিয়েছেন। কারণ, একসঙ্গে বহুফ্রন্টে যুদ্ধে নামলে জয়লাভ করা কঠিন হয়ে যায়। 

এটা ইতিহাসের শিক্ষা। মাও সেতুং ও শনজুর আর্ট অব ওয়ারের বর্ণনায় একসঙ্গে একাধিক ফ্রন্ট খুলতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নেপোলিয়ান ও হিটলারের ভাগ্য বিপর্যয়ের অন্যতম একটি কারণ, তারা উভয়ে একসঙ্গে বহু ফ্রন্টে অভিযান শুরু করেছিলেন। সামরিক যুদ্ধ আর রাজনৈতিক যুদ্ধের ক্ষেত্র ও অস্ত্র ভিন্ন হলেও আর্ট ও স্ট্রাটেজিক কৌশলের মধ্যে অনেক মিল আছে। সুতরাং নিজ দলের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে এই অভিযান একটু দেরীতে শুরু হওয়ারও কারণ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন উপরে উল্লিখিত ফ্রন্টগুলোতে যুদ্ধে ব্যস্ত তখন নিজ দল ও অঙ্গ সংগঠনের একটি অংশ দুর্বৃত্তায়নের সকল সীমা অতিক্রম করেছে। 

তবে ২৭ সেপ্টেম্বরের কালেরকণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান প্রধান খবরগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় সামনের সারির দুর্বৃত্তদের প্রায় সকলেই দলে অনুপ্রবেশকারী। কয়েকটি হেডলাইন প্রসঙ্গের খাতিরে তুলে ধরা একান্ত প্রয়োজন। সেখানে ছাপা হয়েছে- জিয়া-এরশাদের বোমাবাজ বিচ্ছু শামচু আজ দাপুটে হুইপ। ৩২ নম্বর বাড়িতে ফ্রীডম পার্টির হামলায় ক্যাসিনো খালেদ জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করা ক্যাসিনো লোকমানের বিদেশে অঢেল অর্থ, খালেদার নিরাপত্তা প্রধান থেকে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ লোকমান। ঘরের শত্রু বিভীষণ বলে একটা কথা চালু আছে প্রাগঐতিহাসিক যুগ থেকে। এইসব লোকমান, খালেদদের যারা দলে এনেছে, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে তারাও একই দোষে দোষী। এই দুর্বৃত্তরা সুযোগ পেয়ে, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে দুর্নীতি ও লুটপাটে নিমজ্জিত হয়ে এককজন টাকার পাহাড় বানিয়েছে। বস্তায় বস্তায় টাকা ভর্তি করে নিজের বাসাকে টাকার গুদাম বানিয়েছে। 

গত দশ বছরে শেখ হাসিনা বাইরের শত্রুদের পরাস্ত করে দেশকে অনেকটাই জঞ্জাল মুক্ত এবং সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। এবার তিনি বাইরের থেকে নজর ঘরের দিকে ফেরাবেন সেটি বোঝা গিয়েছিল বিগত জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার মাধ্যমে। কিন্তু এই দুর্বৃত্তরা মনে করেছিল তাদের ক্ষমতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চাইতেও বেশি। তাই তারা কোনো ইশারা ইঙ্গিতকে আমলে নেয়নি। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বখরা দিয়ে ভেবেছিল রাষ্ট্র ক্ষমতাকে তারা কুক্ষিগত ও বন্দি করে ফেলেছে। এখানে যে ভুলটি তারা করেছে তাহলো, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সহজাত শক্তিকে গুলিয়ে ফেলেছে। কেউ দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনে সুস্পষ্টভাবে ক্ষমতা ও দায়িত্বের উল্লেখ আছে। তাই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বিশেষ হুকুমের প্রয়োজন ছিল না। নিজেরা ঠিক থাকলে স্বপ্রণোদিত হয়ে আইনের প্রয়োগ করতে পারতেন। 

খবর বেরিয়েছে জিকে শামিম একাই নাকি ক্ষমতাধরদের মধ্যে মাসে ২৫ কোটি টাকা বিতরণ করতেন। মিডিয়ায় তো আসছে। তার সঙ্গে ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে কান পাতলে এখন আরও অনেক খবরই শোনা যায়। শুধু যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নয়, মন্ত্রী-এমপিসহ সব সেক্টরের প্রশাসনের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম এখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, যারা এতদিন ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন এবং মনে করেছেন তারা হয়তো রাষ্ট্র ক্ষমতার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। 

বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার নতুন যুদ্ধে দেশের সর্ব স্তর ও শ্রেণীর মানুষ আজ কাতারবন্দি। মানুষের এখন একটাই চাওয়া। এই অভিযান যেন থমকে না যায়। এর বিস্তৃতি হতে হবে সর্বাত্মক, শুধুমাত্র ক্যাসিনো কেন্দ্রিক যেন না থাকে। এই অভিযানের সফলতার মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি ঘটবে, যার ডাক দিয়েছিলেন বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এই আরাধ্য সাধনে একমাত্র ভরসার জায়গা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আবার প্রমাণ করেছেন রাষ্ট্রের চাইতে কারো ক্ষমতা বেশি নয়।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
sikder52@gmail.com