সঙ্কট কাটছে পেঁয়াজের
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:৫৪ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সোমবার
দেশে পেঁয়াজের সঙ্কট কাটাতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। পেঁয়াজের সরবরাহ ঠিক রাখাসহ মজুত ঠেকাতে মাঠে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০টি টিম। এরই মধ্যে মিয়ানমার, মিশর ও তুরস্ক থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বন্দরে পৌঁছাতে শুরু করেছে। কাল থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করবে টিসিবি।
সারাদেশে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর ঢাকার ৩৫টি পয়েন্টে কাল থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করবে টিসিবি। সকাল ১০টা থেকে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয়। ঢাকা ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে একই দামে পণ্যটি বিক্রি করবে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি মূল্য বৃদ্ধি করে ভারত সরকার। এরপর থেকেই বেশি মূল্যে পেঁয়াজ আমদানি করে আসছে হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকরা।
দুর্গাপূজার বন্ধের আগেই বেশি পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে ভারতে পর্যাপ্ত এলসি দেন ব্যবসায়ীরা। তবে হঠাৎ করে ভারত সরকার গতকাল দুপুর থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এতে ভারতের অভ্যন্তরে পাইপলাইনে থাকা পেঁয়াজ বন্দরে প্রবেশ না করলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করে বন্দরের আমদানিকারকরা।
অন্যদিকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় প্রভাব পড়েছে পাইকারি ও খোলা বাজারে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কেজি প্রতি পেঁয়াজের দাম বাড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।
টিসিবি নির্ধারিত স্থানগুলোতে ট্রাক থেকে জনসাধারণ কেজিপ্রতি পেঁয়াজ ৪৫ টাকায়, চিনি (ফ্রেশ) ৫০ টাকায়, মশুর ডাল ৫০ টাকায় ও লিটারপ্রতি সয়াবিন তেল (তীর) ৮৫ টাকায় কিনতে পারবেন।
টিসিবি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ দুই কেজি পেঁয়াজ, ৪ কেজি চিনি, ৪ কেজি ডাল ও ৫ লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারবেন।
ঢাকা মহানগরীর ৩৫টি স্থান ছাড়াও চট্টগ্রামে ১০টি স্থানে, বাকি ছয়টি বিভাগীয় শহরের পাঁচটি করে স্থানে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি করবেন। এসব ট্রাকে টিসিবি নির্ধারিত পণ্যের মূল্য সংবলিত ব্যানার থাকবে।
শুধু টিসিবির কমদামে পেঁয়াজ বিক্রি নয় সুখবর মিলেছে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রেও। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় আজ সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৬৪ হাজার কেজি পেঁয়াজ। কনটেইনারে করে আমদানি করা এসব পেঁয়াজ খালাসের প্রক্রিয়া চলছে। মিশর ও চীন থেকে এসব পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এ ছাড়াও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের ট্রাক চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, তিনজন আমদানিকারক এসব পেঁয়াজ এনেছেন। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো জেনি এন্টারপ্রাইজ, এন এস ইন্টারন্যাশনাল, হাফিজ করপোরেশন। কনটেইনারবাহী জাহাজ এমভি কালা পাগুরো, জাকার্তা ব্রিজ ও কোটা ওয়াজারে করে এসব চালান এসেছে। এই তিন জাহাজে পেঁয়াজবাহী কনটেইনারের সংখ্যা ১৪টি।
বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম বলেন, কনটেইনারবাহী জাহাজ তিনটির মধ্যে দুটি থেকে কনটেইনারে থাকা পেঁয়াজ খালাস হচ্ছে। আরেকটি জেটিতে ভিড়ানোর পর খালাস হবে।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, জাহাজ থেকে পেঁয়াজ খালাসের পর শুল্কায়ন করে বন্দর থেকে ছাড় নিতে এক-দুদিন সময় লাগে। এ হিসেবে বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পেঁয়াজ কাল-পরশু থেকে বাজারে চলে আসার কথা।
ব্যবসায়ীদের থেকে জানা যায়, চীন ও মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরুর পর হাতে পেতে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগে। বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পেঁয়াজ আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২৫-৩০ দিন আগে। পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর ব্যবসায়ীরা বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানির খোঁজখবর শুরু করেন। বন্দরে আসার পথে আছে আরও কনটেইনারবাহী পেঁয়াজ।
এদিকে পেঁয়াজের সরবরাহ ঠিক রাখাসহ মজুত ঠেকাতে বেশ আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০টি টিম। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০ জন যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এই ১০টি টিম দেশের বিভিন্ন জেলায় গেছে। টিমগুলোর কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনকে যুক্ত হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন সংশ্লিষ্টদের পেঁয়াজ মজুত না করে তা বাজারে ছেড়ে দিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখারও অনুরোধ জানিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজের উৎপাদনকারী জেলা—পাবনা, ফরিদপুর ও নাটোর থেকে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। এই সিন্ডিকেট ভাঙতেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। দেশের পেঁয়াজ সরবরাহকারী জেলাগুলোয় এই টিমগুলোর সদস্যরা অবস্থান করবেন। এ সময় তারা পুরো বিষয়টি তদারকি করবেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, বাজারে পেঁয়াজের মূল্য বাড়ার কারণ খুঁজতে টিমগুলো কাজ করবে। একইসঙ্গে টিমগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে পেঁয়াজের বাজার পর্যবেক্ষণ করবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন বলেন, ‘মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট ৩৫টি ট্রাকে প্রতিকেজি ৪৫ টাকা দরে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি করবে। টিসিবির এই কার্যক্রম ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হয়েছে। তবে, এতদিন ১৬টি ট্রাকে করে বিক্রি করলেও কাল থেকে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়েছে।’
সচিব বলেন, ‘ভারত থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানার পর ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ কেউ মজুত করার চেষ্টা করছেন বলেও তথ্য মন্ত্রণালয়ে এসেছে। যদি কোনও অসাধু ব্যবসায়ী এই পেঁয়াজ মজুত রেখে মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে ইতোমধ্যে মিশর থেকে আমদানি করা দুই জাহাজ পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে বলে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘এক জাহাজের পেঁয়াজ খালাসও করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকেও এলসির পাশাপাশি বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে প্রতিদিনই পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসছে। পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেড় মাসের মধ্যে দেশে নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করবে। এই মুহূর্তে আগামী ২ মাসের প্রয়োজনীয় পেঁয়াজের মজুত রয়েছে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা ট্যারিফ কমিশনের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। চলতি বছর দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ২৩ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদিত পেয়াজের ৩০ শতাংশ পচে যায়। তাই ঘাটতি দাঁড়ায় সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন। এই ঘাটতি মেটাতেই সরকার ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘দেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ উৎপাদনেও সফলতা অর্জন করেছে। তাহলে পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব। তাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে স্থায়ী সমাধানে যাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যেন পেঁয়াজের উৎপাদন আরও বাড়ানো যায় এবং নিজেদের উৎপাদিত পেঁয়াজ থেকেই চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়।’
আরকে//