মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ
১০ সিন্ডিকেটের শাস্তির দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা
শেখ আরিফুজ্জামান, মালয়েশিয়া থেকে :
প্রকাশিত : ১০:০৫ পিএম, ৩ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার
দেশব্যাপী চলমান দুর্নীতি, মাদক ও ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বর্তমানে চালানো শুদ্ধি অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন মালয়েশিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী তার দলের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়ায় ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি শাস্তি চেয়েছেন মালয়েশিয়ায় জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে শ্রমিক পাঠানোর নামে প্রতারণার জন্য জড়িত বাংলাদেশি দশ সিন্ডিকেটের।
জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে শ্রমিক পাঠানোর নামে বাংলাদেশি ১০ সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়কে তোয়াক্কা না করে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো গলাকাটা হারে অভিবাসন ব্যয় হাতিয়ে নেয়। এমনকি বাংলাদেশি ওই ১০ এজেন্সি সিন্ডিকেট করে মানব পাচারের মাধ্যমে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের কারণে মালেয়শিয়া সরকার গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভিসা বন্ধ করে দেয়।
মালয়েশিয়ায় জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে আসা ভুক্তভোগী শ্রমিকসহ ট্রাভেল পাশ নিতে আসা একাধিক প্রবাসীর সঙ্গে কথা বললে তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও ১০ সিন্ডিকেটর শাস্তি দাবি করেন।
ভুক্তভোগীরা বলেন, জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া এসেছি একেকজন সর্বনিম্ন ২ লাখ ৮০ হাজার থেকে থেকে সাড়ে তিন/চার লাখ টাকা দালালের মাধ্যমে এজেন্সিকে দিয়ে। এই হিসাবে একেকজন শ্রমিককে গড়ে খরচ করতে হয়েছে তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকার কাছাকাছি।
এ সময় ভুক্তভোগীরা আরও বলেন, মালয়েশিয়ায় আসার সময় বাংলাদেশ থেকেই তাদের কাছ থেকে ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্পে সরকার নির্ধারিত ‘৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকার বেশি দেইনি’ হলফনামায় সই করিয়ে নেয় ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল বলে অভিযোগ করেন দেশে ফেরত যাওয়ার জন্য ট্রাভেল পাশ নিতে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী।
বিএমইটির ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে ওই দুই বছরে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৪৭৫ জন শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গেছে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। গড় অভিবাসন ব্যয় তিন লাখ ৩৭ হাজার টাকা ধরলে শ্রমিক বাণিজ্যে ৯ হাজার ২১৬ কোটি ১০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছে। সরকার নির্ধারিত টাকা নিলে লেনদেন হতো ৯১৮ কোটি ১৯ লাখ ২৩ হাজার ১২৪ টাকা। অর্থাৎ এজেন্সিগুলো অতিরিক্ত হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় আট হাজার ২৯৭ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৬ টাকা।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তারা সরকারের বেঁধে দেওয়া এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করেই নিয়েছে, তার বেশি নয়। কিন্তু তাদের এই দাবি পুরোপুরিই মিথ্যা বলে জানা গেছে। জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে দুই দেশের সরকার নির্ধারিত শ্রমিক প্রতি অভিবাসন ব্যয় ৩৩ হাজার ৫৭৫ টাকা ধরা হয়। একপর্যায়ে এজেন্সিগুলো এই ব্যয় বাড়িয়ে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা করার দাবি তুললেও তা দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি অনুমোদন দিতে অপারগতা জানায়।
ওই ১০ এজেন্সি সিন্ডিকেটগুলো অতিরিক্ত হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও শ্রমিকদের প্রাপ্তি শূন্য। তারা এত টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েও হয়েছেন প্রতারিত, বঞ্চিত। তাদের পরিবার-পরিজন হয়েছে সর্বস্বান্ত। আর যারা মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন তাদের খরচের টাকা কত বছরে উঠাতে সক্ষম হবেন সেই অপেক্ষায় দিন গুণছেন।
সিন্ডিকেটের এসব ঘটনা নিয়ে দুই দেশেই সরকারি তদন্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ায় দোষীদের বিচার চলছে; অভিযুক্তদের অনেকেই পালিয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন।! যেখানকার লাখো শ্রমিক ভুক্তভোগী, সেখানকার মন্ত্রণালয় বা দুর্নীতি দমন কমিশন আজ পর্যন্ত কারো তদন্তই আলোর মুখ দেখাতে সক্ষম হয়নি। আদালত দোষীদের শনাক্ত করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের রুল জারি করলেও কারো বিচার হয়নি।
এদিকে, সম্প্রতি জাতীয় একটি দৈনিকের হিসাব মতে মালয়েশিয়ায় জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো সিন্ডিকেটের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির একটি আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম। ওই দুই বছরে ৩৮ হাজার ৫৬৬ জন কর্মী পাঠিয়ে শীর্ষে আছে আইএসএমটি।
এর পরই বেশি কর্মী পাঠিয়েছে রুহুল আমিন স্বপনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল—৩৮ হাজার ৪৩৮ জন। ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড কর্মী পাঠিয়েছে ৩৩ হাজার ২৯১ জন। আল ইসলাম ওভারসিসের ম্যানেজিং পার্টনার জয়নাল আবেদীন জাফর পাঠিয়েছেন ২৮ হাজার ৪০৬ জন। আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক রুহুল আমিন পাঠিয়েছেন ৩১ হাজার ১৯২ জন। সানজারি ইন্টারন্যাশনাল ২২ হাজার ৫৬৯ জন। মেসার্স রাব্বি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বশির পাঠিয়েছেন ২১ হাজার ৭২৯ জন। ক্যারিয়ার ওভারসিস কনসালট্যান্স লিমিটেডের পরিচালক এ এস এম খাইরুল আমিন ১৮ হাজার ৭৩১ জন। মেসার্স প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মোস্তফা পাঠিয়েছেন ২২ হাজার ৫৩৪ জন এবং প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস পাঠিয়েছে ১৮ হাজার ১৯ জন কর্মী।
আরকে//