ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

তত্ত্বে ও ভক্তিতে মা দুর্গা

স্বামী ধ্রুবেশানন্দ

প্রকাশিত : ০৩:৩৮ পিএম, ৫ অক্টোবর ২০১৯ শনিবার

শ্রী শ্রী চণ্ডীতে সত্যদ্রষ্টা ‘ঋষি’ এভাবে জগতের অখণ্ড শক্তির স্তুতি করেছেন: ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।’ - অগ্নি ও অগ্নির দাহিকা শক্তি যেরূপ, সেরূপ ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তি অভেদ। সেই মহামায়া নিত্যা (জন্ম মৃত্যুরহিতা), আবার জগৎপ্রপঞ্চই তাঁর মূর্তি, তিনি সর্বব্যাপী; তিনিই এ জগৎ সৃষ্টি করেন, পালন করেন এবং প্রলয়কালে তা ধ্বংস করেন। ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনাই দুর্গপূজা। 

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে শক্তিকে চণ্ডীকা, নারায়ণী, শাকম্ভরী, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী, দুর্গা, কাত্যায়নী ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ভূষিত করা হয়েছে। পৌরাণিক উপমা ও আখ্যান একদিকে যেমন ধর্মের গভীর তত্ত্বকে সহজভাবে উপস্থাপন করেছে, তেমনই আবার দেব-দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনের মাধ্যমে পূজা পার্বণাদিতে উৎসাহিত করে সাধারণ মানুষকে ভগবদভিমুখী করার চেষ্টা করেছে। 

বামন পুরাণে অসুর রাজ মহিষাসুর ও সহিষাসুরমর্দিনী দেবী কাত্যায়নীর আখ্যান রয়েছে। পুরাকালে রম্ভ, করম্ভ নামে দুজন পরাক্রান্ত দৈত্য ছিল। রম্ভ পঞ্চনদীর জলে ও করম্ভ পঞ্চাগ্নির মধ্যে দাঁড়িয়ে পুত্র কামনায় তপস্যারত হয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্র করম্ভকে কুমিরের রূপ ধরে নিহত করেন। রম্ভ অগ্নিদেবের বরে ত্রিকোলজয়ী পুত্র লাভের অধিকারী হয়। রম্ভপুত্র মহিষাসুর বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে পরাক্রমশালী হয়ে উঠল, ইন্দ্র, রুদ্র, সূর্য, মরুৎ ও অন্যান্য দেবতাদের জয় করে স্বর্গলোক দখল করল। 

দেবতারা স্বর্গরাজ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পিতামহ ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু, দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও মহেশ্বর দেবতাদের দুর্দশার কথা শুনে এর প্রতিকারে উদ্যোগী হলেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহাদেবসহ দেবতারা মিলিত হলে সকল দেবতাদের তেজ থেকে কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে এক বিশাল তেজপুঞ্জের আবির্ভাব হল, কাত্যায়ন মুনিও তাঁর তেজ সেই তেজপুঞ্জে সন্নিবেশিত করলেন। 

সহস্র সূর্যের মতো দীপ্যমান সেই বিশাল তেজপুঞ্জ থেকে বিশুদ্ধদেহা প্রদীপ্ত প্রভা দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূত হলেন। দেবতারা তাদের বিভিন্ন অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে দেবীকে সুসজ্জিত ও শক্তিশালী করে তুললেন। এই দেবীই কাত্যায়নী ও দুর্গা নামে পরিচিতা। কাভ্যায়ন মুনি প্রথম এর অর্চ্চনা করেছিলেন বলে তাঁর নাম কাত্যায়নী। এ দেবীর সঙ্গে মহিষাসুর ও অন্যান্য অসুরদের ঘোর যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে অসুররা পরাজিত ও নিহত হয়।

প্রাথমিক স্তরে আমরা ঈশ্বরকে ধারণা করতে পারি না। সেজন্য উপাস্যের ধারণা করার জন্য রূপ কল্পনার, প্রতীক বা প্রতিমার প্রয়োজন হয়। ‘বাপের ফটো দেখলে যেমন বাপের কথা মনে পড়ে প্রতিমা পূজায় ঈশ্বরীয় রূপের ভাবের উদ্দীপন হয়।’ জগতের সাধকগণ অখণ্ড শক্তিকে ‘মা’ রূপে পূজা করেছেন। ভক্তরা দুর্গা পূজায় মাতৃরূপে সেই অখণ্ড শক্তিরই পূজা করে থাকেন। প্রতিমা সাধকের অন্তরের ভাব ও মায়ের স্বরূপেরই মূর্ত প্রকাশ। 

বাঙ্গালী সমাজে ‘মা’ দশভূজা দুর্গারূপে প্রতিমায় পূজিতা। তিনি সিংহবাহিনী, অস্ত্র-শস্ত্র সজ্জিতা; তাঁর পদতলে মহিষ ও মহিষাসুর। তিনি যেন রণাঙ্গনে শত্রু বধে ব্যস্ত। সাধক-ঋষিগণ শক্তির পূজা করেছেন আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে, পরমার্থ লাভের জন্য, যা লাভ করলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়। আমাদের জন্য সাধনার উপযোগী সহজ উপায় নির্দেশ করেছেন, যেভাবে আরাধনা করলে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়।

মানুষের মধ্যে দৈবীভাব ও আসুরিকভাব দুই আছে। দৈবীভাব মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যায় পরমার্থ লাভের যোগ্য করে, আসুরিক ভাব ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, বন্ধনে আবদ্ধ করে। ব্যবহারকালে সরলতা, অহিংসা, সত্য, ক্রোধহীনতা, ত্যাগ, লোভরহিত্য, অনভিমান, ক্ষমা, ধৈর্য, মিথ্যা কথা বর্জন, ভয়শূন্যতা, দান, সংযম, অসৎকর্মে লজ্জা- এসব দৈবীভাবের লক্ষণ। ধর্মধ্বজিত্ব, দর্প, অহঙ্কার, ক্রোধ, বাক্যে ও ব্যবহারে কর্কশভাব, কর্তব্য বিষয়ে অবিবেক- এসব আসুরিকভাব।

যখন মানুষ ভোগতৃষ্ণায় পরিতৃপ্তি লাভের ইচ্ছায় বা বিষয়াসক্ত হয়ে ইন্দ্রিয়ের পশ্চাতে ধাবিত হয়, জগতের অনিত্য বস্তুকে সত্য মনে করে, জীবনের পরম সত্যকে ও ধর্মকে ভুলে থাকে, তখন মানুষের ভেতর আসুরিক ভাবের প্রকাশ পায়। আবার সেই ইন্দ্রিয়গুলোকেই সংযত করে যদি অনাসক্তভাবে কল্যাণ কাজে ও পরমার্থ চিন্তায় নিয়োজিত করা যায় তখনই মানুষের মানুষের দৈবীভাবের প্রকাশ হয়। দুর্গাপূজার প্রতিমায় মহিষাসুরকে আসুরিক ভাবের প্রতীক এবং মহিষকে কামের প্রতীক বলে মনে করা হয় যা ভক্তের শত্রু বলে বিবেচিত; দুইই মায়ের পদতলে মর্দিত হয় এবং অস্ত্রাঘাতে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।

পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয় ও মনকে একাগ্র করার ও শুদ্ধ করার প্রয়াস পাই। আমাদের চিত্ত শুদ্ধ হলে মা আমাদের হৃদয়ে প্রকাশিত হন, আমরা আমাদের আনন্দময় স্বরূপ উপলব্ধি করি। মা শরণাগত সন্তানকে দশহাতে সতত সর্বপ্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন, সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন এবং পরম লক্ষে পরিচালিত করছেন। আবার এ পূজায় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজায় বলির বিধান রয়েছে তাও সেই আসুরিক শক্তির বিনাশ ও দৈবী শক্তি প্রকাশ সম্পর্কিত অনুকল্পের অনুষ্ঠানিক রূপ।

শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠ ও চণ্ডীপূজা দুর্গাপূজার অত্যাবশ্যকীয় অনুষ্ঠান। আখ্যানে আছে- সুরথ রাজা শত্রু কর্তৃক পরাজিত হয়ে রাজ্য হারিয়ে, সমাধি বৈশ্য অসাধু স্ত্রী-পুত্রগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে নিরাশ হৃদয়ে বনে আসেন। হৃতরাজ্যের প্রজা ও লোভী অমাত্যবর্গ, অনুগত প্রজাগণের কথা ভেবে রাজার মন মমতায় আসক্ত, আবার অসাধু আত্মীয় কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েও বৈশ্যের মন তাদের প্রতি স্নেহাসক্ত। ভগ্নহৃদয়ে তাঁরা ঘুরতে গুরতে মেধা মুনির আশ্রমে আসেন। মুনির কাছে ব্যাকুল হয়ে তাঁরা দুঃখ দুর্দশার কথা জানালেন। মুনি মহামায়ার প্রভাব ও তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে তাদেরকে জ্ঞান প্রদান করলেন এবং মহামায়ার স্তুতি করে তাঁর শরণাপন্ন হওয়ার উপদেশ করলেন। রাজা সুরথ ও বৈশ্য মহামায়ার শরণাগত হলেন ও তাঁর কৃপায় তাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হল। 

রাজা সুরথ রাজ্য ফিরে পেলেন এবং বৈশ্যও জগৎ সংসার থেকে মুক্ত হয়ে পরমার্থ লাভ করলেন। মাতৃরূপিণী মহাশক্তির শরণাপন্ন হলে, মা সন্তানের জন্য কল্যাণকর যথার্থ অভীষ্ট প্রদান করেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে তাঁর স্তুতি করে বলা হয়েছে- হে দেবী আপনি স্বর্গ ও মুক্তিদায়িনী, আপনাকে প্রণাম করি।-‘স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে-৮/১১’।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘তিনি লীলায় এ সংসার রচনা করেছেন। এরই নাম মহামায়া।’ তাই সেই শক্তিরূপিণী মা-এর শরণাগত হতে হয়। মায়াপাশ মানুষকে বেঁধে ফেলে। এ পাশ ছেদন করতে পারলেই ঈশ্বর দর্শন হতে পারে। দুর্গাপূজায় ফুল, ফল, নানান উপচারে পূজা, উপাসনা এবং স্তুতির মাধ্যমে ভক্তের মহামায়ারই শরণাপন্ন হবার প্রয়াস।

নবপত্রিকা পূজা দুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গানুষ্ঠান। রম্ভা (কলা), কচ্চী (কচু), হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু, ধান্য-এ নয়টি বৃক্ষের শাখা ও পত্র দিয়ে তৈরি নবপত্রিকারূপিণী দুর্গা যেন সমস্ত জগতের প্রতীক। তিনি জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালন করছেন। এজন্য মা দুর্গার আরেক নাম শাকম্ভরী। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে মহামায়ার স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে- তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষান্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তিরূপে বিরাজিতা। প্রকৃতপক্ষে, মা আমাদের যাবতীয় শক্তির উৎস, তাঁর অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তাঁর শক্তিতেই আমরা শক্তিমান। ‘মা’ নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তাঁরই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাঁকেই লাভ করার চেষ্টা করি।

দুর্গাপূজা সমাজের সকল বর্ণ, শ্রেণী ও পেশার, সকল স্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব; সকলের কল্যাণ ভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডানপাশে রয়েছেন রক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পার্শ্বে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও সম্পদের, গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। একটা সমাজ বা রাষ্ট্রের যথার্থ উন্নতি ও অগ্রগতি তখনই তরান্বিত হয় যখন জ্ঞানের চর্চা, সুদক্ষ প্রতিরক্ষা, পর্যাপ্ত ঐশ্বর্য বা সম্পদ এবং জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যে দেখা যায়। আদর্শ সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে উক্ত চারটি মৌলিক বিষয়ের সমন্বিত ব্যবস্থা যে অত্যাবশ্যকীয়, তা চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করেন। দুর্গাপূজা আমাদের মধ্যে আপাতঃবিভেদ ও বৈষম্য দূর করে সম্প্রীতির ভাব দৃঢ় করে এবং ঐক্যবোধের প্রেরণা যোগায়। এ পূজার মাধ্যমে আদর্শ সমাজের শান্তিপূর্ণ রূপটিই যেন আমাদের কাছে প্রত্যাশিত।

শিবপূরাণে দেবীকে রণরঙ্গিনী বেশে নয়, বর্ণনা করা হয়েছে ‘উমা, হৈমবতীরূপে’। তিনি হিমালয় ও মেনকার কন্যা এবং শিবের পত্নী। দেবী উমা কৈলাসে পতিগৃহে থাকেন। তিনি পতিগৃহ থেকে সিংহের উপর চড়ে বাবা মায়ের ঘরে আসবেন। এজন্যে মা মেনকার ব্যাকুলতা, আগমন প্রতীক্ষায় দিনগুণা, কখন আসবে তার মেয়ে। শিব, উমা, মেনকা ও হিমালয়ের এ পারিবারিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে সাধক কবি সঙ্গীত রচনা করেছেন। এ গানগুলো যেন মা মেনকার তাঁর মেয়ে দুর্গার প্রতি ভালবাসার আধ্যাত্মিক রূপায়ণ। আর এ সঙ্গীতই আগমনী সঙ্গীত হিসেবে সুপরিচিত। বাঙালি সমাজ দুর্গাপূজার পূর্বে আগমনী সঙ্গীতের আসর জমিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। মাকে বরণ করার জন্য, মায়ের পূজার জন্য নিজেকে তৈরি করার এ যেন প্রাক-প্রস্তুতি।

বাঙালি পরিবার যেন মা দুর্গাকে তাদের পরিবারের একান্ত আপনজন হিসেবে পেতে চায়, তাঁকে ভালবাসতে চায়। প্রচলিত আছে উমা প্রতিবছর এ পূজোর সময় ভক্তের গৃহে আসেন এবং তিন দিন তাদের সঙ্গে অবস্থান করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ঈশ্বরকে ভালবাসতে পারলেই তাঁকে পাওয়া যায়। আমাদের পূজা উপাসনার উদ্দেশ্য- তাঁর প্রতি যাতে আমাদের ভালবাসা আসে, সে চেষ্টা। দুর্গাপূজার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরকে ভালবাসারই প্রয়াস পাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘মাতৃভাব শুদ্ধভাব, সাধনার শেষ কথা’। তিনি যে শুধু মাতৃভাবে পূজা করে ঈশ্বরোপলব্ধি করে আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক সংশয়ী মনের সংশয় দূর করেছেন তা নয়, তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রীমা সারদাদেবীকে দেবীর আসনে বসিয়ে মাতৃভাবে (ষোড়শী পূজা) করে জগতে মাতৃশক্তির প্রতিষ্ঠা করেছেন। যতই আমাদের মধ্যে মাতৃভাবের বিকাশ হবে, আমরা ততই পবিত্র হবো এবং উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবো। এতে নারীরাও যথার্থ সম্মানিত ও শ্রদ্ধান্বিত হয়ে সমাজে আসীন হবেন। আর নারীরা যতই এগিয়ে যাবেন, মাতৃত্বের সুমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবেন, তখন সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতি তরান্বিত হবে। মাতৃজাতির মহিমা গুণ কীর্তন করে আমাদের ঋষি মনু বলেছেন (মনু ৩/৫৬)- যে গৃহে নারীগণ পূজিতা হন, সেই গৃহে দেবতাসকলও সানন্দে বিরাজ করেন; আর যে গৃহে নারীগণ বহুমান লাভ না করেন, সে গৃহে দেবতাদিগের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কোন ক্রিয়াই সুফল প্রসব করে না। আর এ জন্যই কুমারী পূজা দুর্গাপূজার এক অত্যাবশ্যকীয় অনুষ্ঠান। 

কুমারী পূজার মূলভাব সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ বেশি।’ শ্রীশ্রীচণ্ডীতেও বলা হয়েছে- ‘স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু/ত্বয়ৈকয়া পূরিতমমবয়ৈতৎ’-হে দেবী, জগতের সকল নারীই আপনার বিগ্রহ। আপনি জননীরূপে এবং একাকিনী এ জগতের অন্তরে ও বাইরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন।

পূজা, উপাসনা, ভাবভক্তি এর মানে তাঁকে (ঈশ্বরকে) ভালবাসা। তাঁকে ভালবাসলে তিনি আমাদের কাছে টেনে নেন। তাঁর কৃপা হলে, তিনি আমাদের হাত ধরে থাকলে দুঃখপূর্ণ সংসার আমাদের বিচলিত ও ভীত করতে পারে না। মায়ের কাছেই সন্তান নিরাপদে থাকে, মা’র নাম করলেই সন্তান নিজেকে শক্তিমান মনে করে। তিনিই বুদ্ধিরূপে আমাদের সমস্ত কল্যাণ কাজের প্রেরণা দেন, আবার শ্রী বা লক্ষ্মীরূপে কল্যাণকারীর গৃহে অবস্থান করেন। তিনি সন্তানকে ভক্তি, জ্ঞান প্রদান করে ভববন্ধন থেকে মুক্ত করেন। 

এ পূজার মাধ্যমে সর্ব শক্তিরূপিণী মায়ের শরণাগত হবার, তাঁকেই ভালবাসবার প্রয়াস। তাঁর প্রতি যেন ভক্তের ভক্তি ও ভালবাসা হয়- এ হোক ভক্তহৃদয়ের একমাত্র প্রার্থনা।

যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।

লেখক : অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা।