মুদি দোকানি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক আরমান
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:৫৪ এএম, ৭ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৮:৫৬ এএম, ৭ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার
শূন্য থেকে বিপুল বিত্তের মালিক বনে যাওয়া এই ব্যক্তির নাম এমরানুল হক আরমান। তিনি যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি। রাজনৈতিক পদ-পদবির সিঁড়ি বেয়ে আকাশ ছোঁয়ার উচ্চতায় পৌঁছেন অতিদ্রুত। ঝুপড়ি ঘর থেকে রাতারাতি স্থান করে নেন বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে।
আরমানের গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মুন্সি রফিকুল ইসলাম। তিনি শৈশবেই ঢাকায় চলে আসেন।
তারপর থেকে এলাকায় যোগাযোগ ছিল না। তবে যুবলীগের পদ পাওয়ার পর থেকে এলাকায় তার যাওয়া আসা আছে। এমনকি দুই বছর আগে স্থানীয় কাচারিবাজার অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব নেন তিনি।
বছর পাঁচেক আগেও অবস্থা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। অট্টালিকা তো নয়ই, থাকতেন ঝুপড়ি ঘরে। মিরপুর-২ নম্বরে ছিল মুদি দোকান। সংসার চালাতে স্ত্রী দর্জির কাজও করতেন। কিন্তু যুবলীগ নামের আলাদীনের চেরাগ তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়।
কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি আর বিশাল বিত্ত-বৈভব যেন জাদুবলে তার কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। সেই টাকায় আবার তিনি সিনেমার প্রযোজনায় নাম লিখিয়েছেন। ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।
সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম সহযোগীও তিনি। তার পরামর্শেই আরমান সিনেমা প্রযোজনায় নাম লেখান। তার প্রযোজনা সংস্থার নাম ‘দেশবাংলা মাল্টিমিডিয়া’। বেশ কয়েকদিন ধরে আরমানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে নজরদারি চালান গোয়েন্দারা।
ফলে তিনি ও তার স্ত্রী ব্যাংক থেকে কোনো টাকা তুলতে পারছিলেন না। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত হতে পারে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে বিদেশ থেকে ‘লাগেজ পার্টির’ আনা ইলেকট্রিক পণ্য বায়তুল মোকাররম এলাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করতেন। পরে তিনি নিজেই লাগেজ পার্টির কারবারে যুক্ত হন।
রোববার আরমানের মিরপুরের ফ্ল্যাটে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় সেখানে উৎসুক জনতার ভিড় জমে যায়। স্থানীয়রা বলেন, হঠাৎ করে আরমানের সবকিছু বদলে যায়।
সেলাই মেশিন ছেড়ে তার স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরতেন আরমান।
র্যাব জানায়, ঢাকার ক্যাসিনো জগতের মূল হোতাদের অন্যতম এমরানুল হক আরমান। তিনি যুবলীগ নেতা সম্রাটের প্রধান সহযোগী হিসেবে পরিচিত। হঠাৎ করে তিনি এত বিত্ত-বৈভবের মালিক কীভাবে বনে গেলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রোববার দুপুরের পর আরমানের মিরপুর-২-এর ১ নম্বর এভিনিউর ১৬ নম্বর বাসার আশপাশে অবস্থান নেয় র্যাব। দুপুর ২টার দিকে তার ফ্ল্যাটে ঢোকার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তালাবদ্ধ থাকায় র্যাব সদস্যরা ফিরে আসেন।
পরে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমানের উপস্থিতিতে ফ্ল্যাটের তালা ভাঙা হয়। ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে ক্যাসিনো সামগ্রীর ছিটেফোঁটাও মেলেনি। তবে পাওয়া যায় বিভিন্ন ব্যাংকের ১২টি চেকবই, এফডিআর এবং জমিজমা সংক্রান্ত বেশকিছু কাগজপত্র।
ব্যাংকের কাগজপত্রের বেশিরভাগই আরমানের স্ত্রী শাহনাজ আক্তারের নামে। বাসার নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, খুব ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে যান আরমানের স্ত্রী।
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, আরমান গ্রেফতার হওয়ার খবর তার স্ত্রী আগেই পেয়ে যান। দুপুর দেড়টার দিকে আরমানের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ।
পরে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে কিছু পাওয়া যায়নি। বাসায় থাকা টাকা এবং স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান।
সূত্র জানায়, আরমান রাজধানীতে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন। ক্যাসিনো থেকে প্রতিরাতে তার আয় ছিল অন্তত ৪০ লাখ টাকা। বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়ে তিনি সিঙ্গাপুর, আবুধাবি ও মালয়েশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন।
আরমান মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে স্থায়ী আবাস গড়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার আগেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ক্যাসিনো-ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ঝলমলে জুয়ার সাম্রাজ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, যুবলীগ নেতা সম্রাটের ক্যাশিয়ার ছিলেন আরমান। এ কারণে ক্যাসিনো থেকে যে টাকা আয় হতো তার বড় একটি অংশ আরমানের কাছে জমা রাখা হতো।
ক্লাবপাড়ার অন্তত ১২টি ক্যাসিনো থেকে আরমান নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। আরমান অস্ত্রের লাইসেন্সও পেয়ে যান। তবে বৈধ অস্ত্রের সঙ্গে তিনি একাধিক অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতেন।
যুবলীগের পদ-পদবির সুবাদে সমাজের প্রভাবশালী মহলে তার ওঠবস শুরু হয়। এমনকি বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল ওপেন সিক্রেট। প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি তুলে তিনি ফেসবুকে পোস্ট করতেন।
আরমান মাদকাসক্ত ছিলেন। প্রতিদিনই গভীর রাত পর্যন্ত তাকে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মদের বারে দেখা যেত। এ ছাড়া সম্রাটের কাকরাইলের অফিসেও তিনি নিয়মিত মদের আসর জমিয়েছেন।