ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

আবরারের মায়ের স্বপ্ন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫২ এএম, ৮ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:১২ এএম, ৮ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। পরিবারের লোকজন তাকে রাব্বি নামেই ডাকত।  আবরার ছিল একটি স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নাম। সহপাঠী, পরিবারের সদস্য ও একমাত্র ছোট ভাইয়ের কাছেও সে ছিল আইকন।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন আবরার। ক্লাসে সব সময় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ  হওয়ার পর ঢাকায় নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর বুয়েটের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস বিভাগে ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। ফাহাদ সেখানে শেরে বাংলা হলের ১০১১ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পাড়িও দিয়েছেন। তবে তরী তীরে ভেড়ার আগেই আবরার চলে গেল না ফেরার দেশে।

আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ ব্র্যাকের অডিটর ছিলেন। চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। মা রোকেয়া খাতুন সোনামণি নামে একটি কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক। সীমিত আয় দিয়ে দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল তাদের। ছেলেকে নিয়ে গর্ব করতেন মা-বাবা। আত্মীয়-স্বজনরাও আবরারকে ভালোবাসতেন। 

১০ দিন আগে ছুটিতে আবরার ও তার ছোট ভাই বাড়িতে এসেছিলেন। ২০ তারিখ পর্যন্ত বাড়িতে থাকতে চেয়েছিলেন আবরার। তবে সামনে পরীক্ষা, পড়া হচ্ছে না বলে রোববার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।

দুই ভাইয়ের মধ্যে আবরার ফাহাদ বড়। ছোট ভাই আবরার ফায়াজ ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সেও ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকে। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের কাছেই তার হোস্টেল।

সন্তানের মৃত্যুর খবরে আবরার ফাহাদের কুষ্টিয়ার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সন্তানহারা মায়ের আহাজারিতে আকাশে বাতাসে ভারী হয়ে উঠছে। তার সন্তান যে আর কোন দিন ফিরবেন না, মানতে পারছেন না তিনি। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন মা। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। তাকে সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনরা।

রোকেয়া খাতুনের বুকফাটা কান্না কোনোভাবেই তাকে সামলানো যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বুক আছড়ে বিলোপ করছেন। আর আবরারকে নিয়ে নানা স্মৃতির কথা বলছেন। এ সময় স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন।

আবরারকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল মায়ের। মা রোকেয়া খাতুন আহাজারি করে বলেন, ‘ছেলেটা ঢাকা মেডিকেল, ঢাবি আর বুয়েটে চান্স পেয়েছিল। সব বিসর্জন দিয়ে ভর্তি হয় বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ার হবে বলে! আজ ছেলেটা লাশ!’

‘তাকে মেডিকেলে পড়তে বলেছিলাম, সে পড়ে নাই; ছেলেটা আজ মেডিকেলের মর্গে!’

অতীতের কথা স্বরণ করে রোকেয়া খাতুন বলছেন, ‘আমার ছেলে তো কারও ক্ষতি করেনি, কোনো দোষ ছিল না তার। তাহলে আমার সোনার ছেলেকে কারা হত্যা করল। সে বাড়ি থেকে গেল, যেতে না যেতেই বাড়ি ফিরছে লাশ হয়ে। এ ছেলে বাড়ি এলেই মজার সব খাবার রান্না করে দিতাম। আর কখনও সে মা বলে ডাকবে না, প্রিয় খাবার খেতে চাইবে না। এ শোক আমি কী করে সইব।’

‘রোববার সকালে আমি তাকে নিজে গিয়ে বাসে তুলে দিই। সে ঢাকায় রওনা দেয়। মাঝে তিন থেকে চারবার ছেলের সঙ্গে কথা হলো আমার। বিকেল পাঁচটায় হলে পৌঁছে ছেলে আমাকে ফোন দেয়। এরপর আর কথা হয়নি। রাতে অনেকবার ফোন দিয়েছিলাম, ফোন ধরেনি।’

রোববার ভোর রাতে ফাহাদের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন তার ছোট ভাই আবরার ফায়াজ।

ছোট ভাই ফায়াজ জানান, ‘ফোন না ধরায় আমি ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ভাইয়াকে নক করি। ভাইয়া ফেসবুকে অ্যাকটিভ ছিল, তবে সাড়া দেয়নি।’

ফায়াজ জানান, ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে হল থেকে ফোন করে জানানো হয় আবরার অসুস্থ, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি। এরপরই রাজধানীর উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন বাবা বরকত উল্লাহ। 

উল্লেখ্য, সোমবার রাত ৩টার দিকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতলা থেকে ফাহাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। 

পুলিশ ও তার পরিবার বলছে, ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। শরীরের পেছনে, বাম হাতে ও কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত আঘাতের কালো দাগ ছিল। 

হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, রোববার রাত আটটার দিকে আবরার ফাহাদসহ দ্বিতীয় বর্ষের ৭-৮ জন শিক্ষার্থীকে শের-ই-বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৭/৮ জন নেতা। তারা আবরার ফাহাদের মুঠোফোন ঘেটে শিবির-সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ খোঁজেন। এক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তাকে পেটাতে শুরু করেন ছাত্রলীগের নেতারা। পরে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ওই কক্ষে গিয়ে আবরারকে আরেক দফায় পেটান। 

নিজ ফেইসবুকে প্রোফাইলে চলমান ভারত-বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।