‘আমরা লজ্জিত আবরার’
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০২:৩৮ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৭:২৫ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। পরিবারের লোকজন তাকে রাব্বি নামেই ডাকত। আবরার ছিল একটি স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নাম। সহপাঠী, পরিবারের সদস্য ও একমাত্র ছোট ভাইয়ের কাছেও সে ছিল আইকন। আবরার ফাহাদের মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। দেশের মানুষের সেবা করবে।
দেশের অন্যায়-অবিচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়তে। সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই ছাত্রলীগের হাতে গণপিটুনি খেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হল এক স্বপ্নবাজ তরুণকে। এই সম্ভাবনাময় তরুণকে হারিয়ে আমরা লজ্জিত। তোমাকে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখালেও দেশের অন্যতম বিদ্যাপিঠ বুয়েট ক্যাম্পাস তোমাকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি।
তার বাবা যখন কবরে মাটি দিচ্ছিলেন তখন ভাবছিলাম এই মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে?এই স্বাধীন দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই। আর কোনো আবরারের এমন মৃত্যু দেখতে চাই না।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন আবরার। ক্লাসে সব সময় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঢাকায় নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর বুয়েটের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস বিভাগে ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন।
ফাহাদ সেখানে শেরে বাংলা হলের ১০১১ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ইতোমধ্যে অনেকটা পথ পাড়িও দিয়েছেন। তবে তরী তীরে ভেড়ার আগেই আবরার চলে গেল না ফেরার দেশে।
বুয়েটের এক শিক্ষার্থী জানায়, আবরার ছিল ক্লাসের হাসিখুশি প্রাণবন্ত শিক্ষার্থী। সারাক্ষণ ক্লাস মাতিয়ে রাখতো হাসি আর আনন্দে। কথাগুলো বলতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছিল। তাসনিনের চোখে তখন আবরারের জন্য কান্না। তার স্মৃতিচারণ কান্না শুরু করে দিয়েছিলেন।
আবরারদের কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডের ও কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গায় গ্রামের বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে। ছেলের শোকে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন রোকেয়া থাতুন। ছোট ভাইটিও তার বন্ধুর মত বড় ভাইকে হারিয়ে এক বাকরুদ্ধ। খুনিদের দ্রুত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন তার শোকার্ত স্বজন, প্রতিবেশি ও বন্ধুরা।
আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ ব্র্যাকের অডিটর ছিলেন। চাকুরি থেকে অবসরে গেছেন। মা রোকেয়া খাতুন সোনামনি নামে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক। সীমিত আয় দিয়ে দুই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল তাদের। ছেলেকে নিয়ে গর্ব করতেন মা-বাবা। আত্মীয়-স্বজনরাও আবরারকে ভালবাসতেন।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে কুমারখালীর গ্রামের বাড়ি এসে থেকে শহরের পিটিআই রোডে জমি কিনে বাড়ি করে তার পরিবার। এ বাড়িতে আবরারের মা ও বাবা বসবাস করেন। তিন কক্ষের বাসার একটি কক্ষে আববার ছুটিতে এসে থাকতেন। সেই ঘর জুড়ে বই খাতা পড়ে আছে।
একটি কক্ষে বুকফাটা কান্না করছেন আবরারের মা রোকেয়া খাতুন। সেখানে বিছানার ওপর আবরারের অনেক আত্মীয়-স্বজনও রয়েছে। কোন ভাবেই রোকেয়া খাতুনকে সামলানো যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে বুক আছড়ে বিলোপ করছেন। আর আবরারকে নিয়ে নানা স্মৃতির কথা বলছেন। এ সময় স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
আবরারের মা বলেন, 'আমার ছেলেতো কারো ক্ষতি করেনি, কোন দোষ ছিল না তার। তাহলে আমার সোনার ছেলেকে কারা হত্যা করলো। কেবল সে বাড়ি থেকে গেল। যেতে না যেতেই বাড়ি ফিরছে লাশ হয়ে। এ ছেলে বাড়ি আসলেই মজার সব খাবার রান্না করে দিতাম। আর কখনো সে মা বলে ডাকবে না, প্রিয় খাবার খেতে চাইবে না। এ শোক আমি কি করে সইবো।'
এ সময় বাড়ির আশেপাশে ও সড়কের ওপর স্বজনদের জটলা। আবরারের ছোট ভাই ঢাকা কলেজ ছাত্র আবরার ফায়াজ সাব্বিরও বলে, 'দুই ভাই ঢাকায় একসঙ্গে থাকায় প্রায় দিনই দেখা হতো। সব সময় ফোনে খোঁজ খবর রাখত। বড় ভাইয়াকে আমি সব সময় অনুসরণ করতাম। ভাইয়া প্রকৌশলী হয়ে আমাদের পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিল। মা-বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল ভাইয়াকে নিয়ে। সেটা শেষ হয়ে গেল। আমি দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই।'
এর আগে সকালে ছেলের লাশ আনতে ঢাকায় যাওয়ার আগে আবরারের বাবা বরকতুল্লাহর সঙ্গে কথা হলে বলেন, 'ছেলেকে তিনি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। কোন দলের রাজনীতি তো দূরের কথা, পড়ালেখার বাইরে সে আন্য কিছু চিন্তা করতো না। বাবার কাঁধে ছেলের লাশ অনেক ভারী। এখন আমরা কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব। ও তো লেখাপড়া শিখে পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিল। সব স্বপ্ন নিভে গেল।'
প্রতিবেশিরা জানান, আবরার খুবই নরম স্বভাবের ছিল। সবার সঙ্গে আলাপ করতো। দেখা হলে সালাম দিত। বাড়িতে খুব একটা আসতো না। আসলে পাড়ার মসজিদে নামাজে যেত। তার পরিবারের লোকজনও খুবই ভাল।
পরিবার সূত্র জানায়, সপ্তাহ খানেক আগে ছুটিতে কুষ্টিয়ার বাড়িতে বেড়াতে আসেন আবরার ফাহাদ। তবে বাড়িতে এসে পড়ালেখা ঠিক মত না হওয়ায় আগেভাগেই ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। রোববার সকালে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় আববার। সকালে তার মা ঘুম থেকে ডেকে তুলে দেয়।
এরপর ঢাকায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত মোবাইল ফোনে ৪ বার কথা হয়। আর ঢাকা পৌঁছে বিকেলের দিকে মাকে ফোন করে জানান পৌঁছানোর বিষয়টি। মোবাইলে এটিই তার মায়ের সঙ্গে শেষ কথা। আর সারারাত ফোন দিয়েও ছেলের খবর না পেয়ে বিচলিত হয়ে উঠেন মা রোকেয়া। সকালে খবর পান তার ছেলে আর বেঁচে নেই।
শিবিরের সঙ্গে আবরারের সম্পৃক্ততার কথা বলা হলেও তার পরিবারের লোকজন দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে এলাকায় পরিচিত। পদ-পদবি না থাকলেও সক্রিয়ভাবে তারা মাঠে থেকে কাজ করে। কয়ার রায়ডাঙ্গা গ্রামে বরকতুল্লাহর প্রতিবেশি ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন,' আবরারের বাবা বরকত চাচা আওয়ামী লীগের একজন পাকা সমর্থক। অনেক মিছিল মিটিং তিনি আমাদের সঙ্গে করেছেন। দলের দুঃসময়ে তিনি আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করেছেন।
নির্বাচন আসলে তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করতেন। তার পরিবারের সবাই শিক্ষিত। এলাকায় তাদের সুনাম রয়েছে। তবে আববারের ছোট চাচা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির করতো বলে শুনেছি। আজ সকালে আবরারের লাশ কুষ্টিয়া আনে। এরপর গ্রামের বাড়ি রায়ডাঙ্গায় দাফন করা হয়।
টিআর/