আবরার, ক্ষমা করো সন্তান আমার
ড. রকিবুল হাসান
প্রকাশিত : ০৩:৫৪ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:৫২ এএম, ৯ অক্টোবর ২০১৯ বুধবার
আবরার, বাবা, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। এই লেখাটি লিখতে বসে মনে হচ্ছে বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ আমিও যেন আমার কাঁধে সন্তানের লাশ নিয়েই লিখছি। তুমি যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা এসেছিলে, এই একই স্বপ্ন নিয়ে আমিও প্রায় পঁচিশ বছর আগে ঢাকা এসেছিলাম। তবে তোমার মতো করে নয়, তোমার মতো অতো মেধাবী আমি ছিলাম না।
আমাদের এলাকাতে তোমার মতো অতো মেধাবী তো আর কেউই ছিল না কেউই নেই। তুমি আর আমি একই এলাকার সন্তান। তোমার বাবা আমার বিদ্যালয়ের বড় ভাই। তোমার বাড়ি আমার বাড়ি হেঁটে গেলে বড় জোর আধা ঘণ্টার পথ। বড় ভাই হিসেবে তোমার বাবা আমাদেরও মান্য ছিলেন আদর্শ ছিলেন। তুমি একটি আদর্শ পরিবারের সন্তান হয়ে দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র হয়ে ঢাকায় এসেছিলে দেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলে।
আমাদের আর কেউতো এমন সাফল্যেও পথে পা রাখতে পারেনি। যা শুধু তুমিই পেরেছিলে। আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে তোমার মতো করে তোমার মতো অতো মেধাবী আর কেউ আমাদের এলাকা থেকে ঢাকায় পড়তে আসেনি। আমরা যা পারিনি তুমি তা পেরেছিলে।
কিন্তু এই পারাটাকে কেন এভাবে হত্যা হতে হলো। পেশাগতভাবে আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি যদি বলি একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের কাছে নিজের গ্লানি হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে আমাদের সোনার টুকরো সন্তানরা হত্যা হচ্ছে দেশের স্বপ্নের কবর রচনা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ নয়? এ তো ঘরের ছেলের নিজের ঘরে অনিরাপদ জীবন।
আবরার, বাবা, আমি নিশ্চিত তোমার সাথে আমার দেখা হলে, তুমি বলতে চাচা, তুমি কেমন আছো? বাসায় সবাই কেমন আছে? তোমার বিশ্ববিদ্যালয় কেমন চলছে? আহা! আমার সন্তান এভাবে কেন তোমাকে আমার হারাতে হলো, বাবা? তোমার বাবার মতো ভালো মানুষ ক’জন আছেন তুমি তো সেই বাবার সন্তান তোমাকে নিয়ে গোটা এলাকা স্বপ্ন দেখেছিল, সেই স্বপ্ন এখন বাংলাদেশের কান্না হয়ে গেলো কেন?
সারা দেশের মানুষ যেখানে তোমার সাফল্যে উৎসব করবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিল, সেই উৎসব বড় অসময়ে লাশ হয়ে চোখের জলে কেন কথা বলছে? এরকম করে তো বাবা তোমাকে আমরা চাইনি। তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আমরা এই শহরে দেশের সবচেয়ে সেরা বিদ্যাপিঠে তোমার পড়ালেখা তো বটেই তোমার জীবনেরই নিরাপত্তা দিতে পারিনি। বড় এক দুর্ভাগা দেশে জন্মেছিলে তুমি, যে দেশ তার সোনার টুকরো সন্তানকে বাঁচার নিশ্চয়তা দিতে পারলো না।
তোমাকে যারা হত্যা করলো, তারাও তো এদেশেরই সবচেয়ে মেধাবী সোনার টুকরো সন্তান তারাও তো আমাদেরই সন্তান আমাদেরই স্বপ্ন আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তারা কেন তাদের প্রিয় বন্ধুকে হত্যা করে? তারা কেন তাদের সোনালী আগামী সোনার বাংলাদেশের বুক রক্তাক্ত করে? এমন সোনার টুকরো ছেলেরা কেন তবে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে মতো পথ বেছে নেয়? কী মোহে তারা এমন পাগল হয়ে যায়? ওরা সবাই তো আমাদের উজ্জ্বল আগামী সোনার বাংলাদেশ।
আবারারের বাবা বরকত ভাই কাঁদছে, মা কাঁদছে, ভাই কাঁদছে, কাঁদছে তো গোটা বাংলাদেশ। আবরার, আমরা তো চাইনি বাবা, এভাবে কাঁদুক গোটা দেশ এভাবে কাঁদুক তোমার গ্রাম-কাদুঁক তোমার পরিবার। তুমি তো এরকম মৃত্যু-স্বপ্ন নিয়ে বুয়েটে ভর্তি হওনি। তুমি তো এদেশের উজ্জ্বল আগামীর নির্মাতা হবে বলে সাধারণ একটা গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলে কী দুর্দান্ত মেধার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে। এমন মেধাবী সন্তান ইচ্ছে করলেই কী জন্ম দেয়া যায়! তাহলে তোমার জন্ম হতে আমাদের এতো শত বছর লেগে গেলো কেন?
তোমার বাড়িটা তো বাঘা যতীনের বাড়ির পাশেই। সাহসের আলোটা হয়তো সেখান থেকেই জ্বলেছিল অন্তরে তোমার। সেই সাহসেই হয়তো তুমিও চেয়েছিলে এদেশকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে। নিজেকে গড়েও তুলেছিলে সেইভাবে। বাঁকি ছিলো শুধু দূর্বার গতিতে বাঁকি পথটুকু হেঁটে যাওয়া তা তো অনায়াসেই পারতে তুমি। আর তাতেই বাংলাদেশের মুখ হয়ে উঠতো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। আমরা আনন্দে গর্বে তোমাকে মাথায় তুলে উৎসবের রঙ মাখতাম। সে রঙ কেন বড় অসময়ে তোমার মৃত্যু রচনা করলো? যেভাবে তোমাকে হত্যা করা হলো ভাবতে গেলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
আমরা যা পারিনি তুমি সন্তান হিসেবে সে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলে। তোমার গ্রাম, তোমার এলাকা, তোমার বাংলাদেশ, তোমার নামে আলোকিত হবে। আমাদের ইতিহাসে তুমি অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছিলে। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাদের সন্তান বড় হচ্ছে এলাকার আলো হয়ে ফুটে উঠছে আমরা গর্ব করে বলতাম- আবরারের নামে আমাদের গ্রাম একদিন খ্যাত হবে, একদিন আলোকিত হবে।
তবে কেন এই অসময়ে কবরের অন্ধকার নেমে এলো তোমার জীবনে? কেন আমাদের সব স্বপ্ন রক্তাক্ত হয়ে লাশ হয়ে গেলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানি না বাবা। আমাকে ক্ষমা করো আমাদের তুমি ক্ষমা করো। তোমাকে বাঁচাতে পারিনি তোমার বাঁচার নিরাপত্তা দিতে পারিনি তোমাকে নিয়ে আমরা খুব বেশি স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম। তোমার মতো অতো মেধাবী আর কেউ ছিল না আমাদের। স্বপ্নটা তাই তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি ছিল। আমি তো লেখালেখি করি তুমি জানো, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি তাও জানতে, তুমি বলতে আমাদের দেখে ঢাকায় এসেছো আমাদের মতো বড় হবে।
কিন্তু তুমি জানলে না আমরা তোমাকে নিয়ে কতো বড় স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের দেখে তুমি যে ঢাকায় এসেছিলে, সেই ঢাকা যে তোমার মৃত্যুকূপ ছিলো আমরাও তো জানতাম না। আমরা এমই অক্ষম তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। এই অক্ষমতার কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও ক্ষমা চাই ক্ষমা করো, আবরার, সন্তান আমার।
একদিন তোমাকে নিয়ে লিখবো এই স্বপ্নটা বুনে রেখেছিলাম যেদিন তুমি অনেক বড় হবে সাফল্যে আকাশ ছুঁবে, তোমাকে নিয়ে গোটা বাংলাদেশ গর্ব করবে তখন আমিও তোমার এলাকার সামান্য মানুষ হিসেবে লিখতে চেয়েছিলাম। আবরার, তুমি আমাদের সন্তান। তোমার সাফল্যে দেখো তোমার এলাকার মানুষ আনন্দে পাগল হয়ে উড়ছে আকাশে। কিন্তু বাবা, এরকম লেখা তো তোমাকে নিয়ে কোনোদিন লিখতে চাইনি। আমার বুকের ভেতর যে কষ্ট সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে আমার চোখ ভেঙে যে পানি অঝোরে ঝরছে আমার কাঁধে যে সন্তানেরই লাশ।
তুমি বলতে পারো বাবা, এই লেখাটা আমাকে দিয়ে কেন লেখালে? কারা লেখালো? এক বুক কান্না নিয়ে এই লেখার প্রতিটি শব্দ বসাতে হচ্ছে এ যেন আমার সন্তানেরই কবরে পাথরভারি হাতে মুঠোতে মাটি নিয়ে মাটি ছড়িয়ে দেয়ার মতো। বাবা, তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। তুমি আমাদের দেখে যে ভরসায় ঢাকা এসেছিলে সোনার টুকরো সন্তান হয়ে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা করো, বাবা আমার, ক্ষমা করো প্রিয় সন্তান।
(ড. রকিবুল হাসান, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ)