কাউন্সিলর রাজীবের যত অপরাধ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০১:১২ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০১৯ রবিবার
একে একে সম্পদের পাহাড়ের ওপর পাহাড় গড়েছেন তিনি। বেশ সুলতানি ঢং তার রামরাজত্বে। আয়েশি এবং খামখেয়ালি জীবনযাপন তার। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও রয়েছে যার। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হলে তিনি গা ঢাকা দেন। অবশেষে ধরা খেলেন সুলতান রাজীব।
গতকাল শনিবার রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। রাতভর এ অভিযানে শুধুমাত্র পাঁচ কোটি টাকার চেক ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। র্যাবের ধারণা, আগে থেকেই সতর্ক থাকায় কাউন্সিলর রাজীব আর্থিক লেনদেনের আলামত সরিয়ে ফেলেছেন। এ সময় এই বাসা থেকে সাতটি বিদেশি মদের বোতল, একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, তিন রাউন্ড গুলি, নগদ ৩৩ হাজার টাকা ও একটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়।
যদিও রাজীবের অপরাধের ডালপালার হিসেব পাওয়া বেশ কঠিন। তারপরেও প্রচলিত এই কাউন্সিলর নিজের এলাকায় গড়ে তুলেছেন রাজত্ব। চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, টেন্ডারবাজি, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আর মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত করেছেন তার সাম্রাজ্য। মোহাম্মদপুরের বসিলা, ওয়াশপুর, কাটাসুর, গ্রাফিক্স আর্টস ও শারীরিক শিক্ষা কলেজ, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি এবং বাঁশবাড়ী এলাকায় তৈরি করেছেন একক আধিপত্য।
২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। দলীয় প্রার্থী ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে হারিয়ে নির্বাচিত হন তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই রাজীবের রাজনৈতিক জীবন শুরু। অল্পদিনেই নেতাদের সান্নিধ্যে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন তিনি। উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হওয়ার সময় রাজীব মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। নির্বাচনে জয় লাভের কিছুদিন পর রাজীবের লোকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা পাইন আহমেদকে মারধর করেন। ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে যায়। পরে তাকে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কারের কিছুদিন পর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এমনকি তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের (সদ্য বহিষ্কৃত) দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ফের পদে আসীন হন তিনি।
শনিবার রাতে রাজীবকে গ্রেফতার করার পর তাকে দ্বিতীয়বারের মতো বহিষ্কার করে যুবলীগ।
কাউন্সিলর নির্বাচন করার আগে রাজনীতির পাশাপাশি এক চাচাকে কাজকর্মে সহযোগিতা করতেন। ওই চাচা ঠিকাদারি করতেন। নির্বাচনের সময় তার ওই চাচা একটি জমি বিক্রি করে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে তাকে কাউন্সিলর নির্বাচন করতে সহযোগিতা করেন। ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় এখন ওই চাচার সঙ্গেও যোগাযোগ নেই।
প্রায় ছয় বছর আগে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির একটি বাড়ির নিচতলার গ্যারেজের পাশেই ছোট্ট এক বাড়িতে সস্ত্রীক ভাড়া থাকতেন তারিকুজ্জামান রাজীব। ভাড়া দিতেন ৬ হাজার টাকা। তবে ছয় বছর শেষে একই হাউজিং এলাকায় নিজের ডুপ্লেক্স বাড়িতে থাকেন। নামে-বেনামে তার অন্তত ৬টি বাড়ি রয়েছে মোহাম্মদপুরে। রয়েছে দেশ-বিদেশে সম্পত্তিও। ছয় বছর আগে একমাত্র বাহন অল্প দামি একটি মোটরসাইকেল থাকলেও ছয় বছর শেষে হয়েছে কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল ৮-১০টির বেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনেছেন রাজীব। যার মধ্যে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টস কার রয়েছে। এই গাড়িগুলোর বেশ কয়েকটি নম্বরের রেজিস্ট্রেশন নেই। ভুয়া নম্বর ব্যবহার করে তিনি গাড়িগুলো চালাচ্ছেন।
স্থানীয়রা বলেন, কমিশনার হওয়ার পরপরই রাজীব তার ক্যাডার বাহিনীর প্রচারণায় বনে যান স্বঘোষিত ‘জনতার কমিশনার’। আর এই ‘জনতার কমিশনার’ জনতার কাছ থেকেই চাঁদা তুলেন কোটি কোটি টাকা। দখল করেন জনগণের জমি। বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, ফুটপাথই তার চাঁদা তোলার মূল উৎস।
মোহাম্মদপুর থেকে আল্লাহ করিম মসজিদ পর্যন্ত পুরো ফুটপাথ থেকে প্রতিদিনই চাঁদা তুলেন তার লোকজন। মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নং রোড এলাকায় পানির পাম্পের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বাড়ি বানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করে অত্যাধুনিক ফিটিংস দিয়ে রাজপ্রাসাদের আদলে আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি বানান তিনি। শুধুমাত্র বাড়ির জায়গাটির দাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। বাড়িটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে আরো দুই কোটি টাকা। এ ছাড়াও মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, দুবাইতে বুর্জ খলিফার পাশে একটি বাড়ি এবং সৌদি প্রবাসী মিজান নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে হোটেল ব্যবসায় অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে আলোচনা রয়েছে তার এলাকায়। মোহাম্মাদীয়া হাউজিং’এ রহিম ব্যাপারী ঘাট মসজিদের সামনে আবদুল হক নামে এক ব্যক্তির ৩৫ কাঠার একটি প্লট যুবলীগের কার্যালয়ের নামে দখল, ওই জমির পাশেই জাকির হোসেনের ৭-৮ কাঠার ১টি প্লট দখল করেছিলেন। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে ময়ূর ভিলার মালিক রফিক মিয়ার কয়েক কোটি টাকা দামের জমি দখল করেন রাজীব। পাবলিক টয়লেট নির্মাণের মাধ্যমে জমিটি দখল করলেও সেখানে ৫টি দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন। ঢাকা রিয়েল এস্টেটের ৩ নম্বর সড়কের ৫৬ নম্বর প্লট, চাঁদ উদ্যানের ৩ নম্বর সড়কের রহিমা আক্তার রাহি, বাবুল ও জসিমের ৩টি প্লটসহ অন্তত ১০টি প্লট দখল করেছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গতকাল শনিবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীত পাশের ৮নং সড়কের ৪০৪ নং বাসায় অভিযান চালিয়ে কাউন্সিলর রাজীবকে গ্রেফতার করে র্যাব। রাতভর অভিযান শেষে র্যাব-১ এর প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাজীবকে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বন্ধুর বাসা থেকে গ্রেফতারকৃত রাজীবকে প্রথমে তার নিজ বাসভবন এবং পরবর্তীতে দাপ্তরিক কার্যালয়ে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। শনিবার রাত থেকে শুরু করে রোববার ভোররাত পর্যন্ত এ অভিযান চালানো হয়। এসময় রাজীবের ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে সাদেকুর রহমান সাদেক নামের এক ব্যক্তিকে ৩ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। এছাড়া রাজীবের বিরুদ্ধে অস্ত্র এবং মাদক আইনে দুটি পৃথক মামলা হবে বলে জানান তিনি। গত ১৩ অক্টোবর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।