যুবলীগে আসছে ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৩৯ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৫:৪১ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০১৯ রবিবার
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের নানা অপরাধমূলক ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দলটির ভাবমূর্তি ভেতরে ও বাহিরে সমালোচিত হচ্ছে। ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া দলটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী ক্লিন ইমেজের নেতৃত্বের কথা ভাবছেন।
তাহলে কারা আসছেন যুবলীগের নেতৃত্বে? অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্নটি। কারণ এর ওপরেই নির্ভর করবে- শুদ্ধি অভিযানের মতো বড় ধাক্কার পর কেমন হবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি।
যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সকলেই চাচ্ছেন যুবলীগের নেতৃত্বে আসুক তরুণ ও সৎ লোকজন। আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন। তার আগেই নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলের চারটি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলন। ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেস।
প্রতিবারই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা হলে প্রতিবারই উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করে সারা দেশের যুবলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে। যার যার অবস্থান থেকে প্রার্থিতা জানান দেন। সংগঠনটির শীর্ষ পদপ্রত্যাশীরা লবিং-তদবিরে ব্যস্ত সময় পার করেন।
এবারের চিত্রটা একটু ভিন্ন। অনেকেই প্রকাশ্যে নিজ নিজ প্রার্থিতার বিষয়ে এখনই ঘোষণা দিচ্ছেন না। ক্যাসিনো, মাদক ও টেন্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় কারো কারো নাম আসায় অনেকটা চুপচাপই রয়েছেন তারা। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু অভিনিউ ও ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে নিয়মিত যাওয়া-আসা করছেন। যোগাযোগ বাড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে।
জানা গেছে, ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সম্মেলনে চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক পদে অনেকেই আলোচনায় আছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বতর্মান কমিটির ১ নং সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী লিটন ও শেখ ফজলে ফাহিম, যিনি এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের নামও শোনা যাচ্ছে কাউন্সিলের আগে।
এছাড়া আছেন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম, বর্তমানে প্রেসিডিয়াম সদস্য শহীদ সেরনিয়াবাত, ফারুক হোসেন, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, আতাউর রহমান, অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন, শেখ ফজলে নাঈম চেয়ারম্যান পদে আলোচনায় আছেন। তবে চেয়ারম্যান পদে বিশেষ আলোচনায় আছেন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মাশরাফি।
আলোচনায় আরো যারা আছেন- তাদের মধ্যে সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, সুব্রত পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হাসান তুহিন, অর্থ সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হালদার, উপ-গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলু, উপশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক কাজী মাজহারুল ইসলাম, কার্যনির্বাহী সদস্য ব্যারিস্টার আলী আসিফ খান।
১৯৭২ সালের নভেম্বরে শেখ ফজুলল হক মনির হাত ধরে যুবলীগের পথচলা শুরু। এর পর থেকে যারাই যুবলীগের নেতৃত্বে এসেছেন প্রত্যেকেরই দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পন্ন ছিলেন। তাদের মেধা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল আকাশচুম্বি। যুবলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমদের মতো দক্ষ সংগঠক।
তাদের কোনো কমিটি নিয়েই এতটা সমালোচনা হয়নি, যতটা হচ্ছে বর্তমান কমিটি নিয়ে। যুবলীগের খোদ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সংগঠনের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর। তাদের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্নীতির মাধ্যমে কাড়ি কাড়ি টাকা অর্জনের। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসার।
এদিকে স্পষ্টভাষী আর ‘একক সিদ্ধান্তে’ সংগঠন পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী হঠাৎ দলের ভেতরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। যে সংগঠনে টানা ১০ বছর তিনিই ছিলেন হর্তাকর্তা, আজ সেই সংগঠনের কোথাও নেই এ নেতা। এক কথায় তার নীরব পতন হয়েছে। তাকে বাদ দিয়েই দিব্যি চলছে সবকিছু।
এদিকে রোববার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে যুবলীগের নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এতে আসেননি যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তাকে অংশ নিতে নিষেধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংগঠনটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনকেও ঐ বৈঠকে না থাকতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, বৈঠকটি যুবলীগের সম্মেলন উপলক্ষ্যে হলেও এতে যুবলীগ চেয়ারম্যানের ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে। এছাড়া যুবলীগের নেতৃত্বে যারা আসবেন তাদের বয়স নির্ধারণ নিয়েও নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। যুবলীগ নেতাদের সর্বোচ্চ বয়স ৪৫ থেকে ৫০ বছর নির্ধারণ করা হতে পারে।
এছাড়া সম্মেলনের নানা দিকসহ ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ যুবলীগের সম্মেলনের তারিখও নির্ধারণ করা হতে পারে। যুবলীগের বিদ্যমান গঠনতন্ত্রে বয়সের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও এবার বয়সকেও একটা মানদণ্ড ধরা হতে পারে। বিশ্বের শীর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশেই যুব রাজনৈতিক ইউনিটগুলোর জন্য বয়সের একটা নির্দষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক রয়েছে।
বিতর্কিত ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটিতে কোন পদ পাবেন না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি রোববার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয়ের সভা কক্ষে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন।
জানা যায়, যুবলীগের সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১২ সালের ১৪ জুলাই। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন হারুন-অর-রশিদ। ১৪৯ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিতে চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর অনেকটাই একচ্ছত্র অধিপত্য ছিল। পরে আরও দু'জনকে নিয়োগ দিয়ে ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়। সংগঠনে ওমর ফারুকের কথাই ছিল শেষকথা। আওয়ামী লীগের একমাত্র সংগঠন, যেখানে কর্মীরা তাদের সংগঠনের প্রধানকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে হয়।
এদিকে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হলেও যুবলীগের আর সম্মেলন হয়নি। যুবলীগের দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন একক অধিপত্য থাকা যুবলীগ চেয়ারম্যানের ইন্ধনেই বেপরোয়া হয়ে উঠে সম্রাট-খালেদরা।
অভিযোগ রয়েছে, যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিজের অনুগতদের বসিয়েছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। ঢাকা মহানগর ও দেশব্যাপী জেলা কমিটিগুলোও হয়েছেন তার পকেটের লোক দিয়ে। নিজেকে তরুণ ভাবাপন্ন ৭১ বছর বয়সী ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই একক ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। শুরুতে সাবেক নেতাদের পরামর্শ ছাড়াই একটি ঢাউস কমিটি গঠন করেন তিনি। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি অনেক নেতাকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। পদভেদে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। ফ্রিডম পার্টি ও যুবদলের অনেকে টাকার বিনিময়ে ঠাঁই পেয়েছেন যুবলীগে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
এমএস/