যে ১১ দাবিতে ধর্মঘটে ক্রিকেটাররা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:১৫ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৬:১৬ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০১৯ সোমবার
সংবারদ সম্মেলনে কথা বলছেন সাকিব
দীর্ঘদিন ধরেই নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছিলেন জাতীয় দলসহ দেশের বিভিন্ন স্তরের ক্রিকেটাররা। বিশ্বের চতুর্থ ধনী ক্রিকেট বোর্ড হয়েও এসব ক্রিকেটারদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা এবং আনুসাঙ্গিক সুবিধা দিচ্ছিল না বিসিবি। একইসঙ্গে দিনে দিনে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান। স্থবির হয়ে পড়েছে ক্রিকেটারদের সংগঠন 'কোয়াব'ও।
সব মিলিয়ে ক্রিকেটারদের মধ্যে ধীরে ধীরে জমে থাকা ক্ষোভগুলো আজ যেন বিস্ফোরিত হল। যার প্রেক্ষিতে খেলা ছেড়ে ধর্মঘটের মত আন্দোলনে নামলেন সাকিব-তামিমরা। এ উপলক্ষে মিরপুর স্টেডিয়ামে সোমবার বিকেলে ১১ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য খেলা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন ক্রিকেটাররা।
মাঠে যেমন একটি দলকে এগিয়ে নেয় ১১ জন, ক্রিকেটারদের এই দাবিগুলোও যেন ঠিক তেমনই। দেশের ক্রিকেট এগিয়ে নেয়ার দাবি। সাকিব-তামিম-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহ-নাঈম ইসলাম-এনামুল হকরা...একে একে পড়ে শোনালেন ১১টি দাবি— আসুন দেখে নেয়া যাক, কী আছে ক্রিকেটারদের সেই ১১ দফা দাবিতে-
১. প্রথমেই সম্মানের ব্যাপারে। আমরা যারা ক্রিকেটার আছি, যতটুকু সম্মান আমাদের পাওনা ততটুকু মনে হয় না পাই। আমাদের খেলোয়াড়দের যে সমিতি আছে (কোয়াব), তাদের কোনও কার্যক্রম নেই। খেলোয়াড়দের প্রতিনিধি হয়ে আমাদের জন্য যে কিছু করবে- সেটা আমরা কখনও দেখিনি। আমাদের দাবি হচ্ছে, যারা এখন এই সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক আছে তাদের দ্রুত পদত্যাগ করতে হবে। সামনে কে এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি হবে সেটা আমরা নির্বাচন করে ঠিক করব।
২. কত কয়েক বছর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের পরিস্থিতি কী নিশ্চয়ই জানেন। যেভাবে লিগ হচ্ছে, সব খেলোয়াড় এটা নিয়ে অসন্তুষ্ট। পারিশ্রমিকের একটা মানদণ্ড বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে খেলোয়াড়দের খেলতে হচ্ছে। আগে যেভাবে প্রিমিয়ার লিগ খেলতাম, যেভাবে আমরা ক্লাব অফিশিয়ালদের সঙ্গে চুক্তি করতাম...খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক নিয়ে তারা সক্রিয় থাকত। খেলোয়াড়েরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ক্লাব ঠিক করতে পারত। আমাদের দাবি, আগের মতো যেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ফিরে পাই।
৩. এ বছর বিপিএল অন্য নিয়মে হচ্ছে। এটাকে সম্মান করি। তবে আমাদের দাবি, আগের নিয়মে বিপিএল যেন ফিরে আসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, স্থানীয় ক্রিকেটাররা যেন বিদেশি ক্রিকেটারদের মতো ন্যায্য পারিশ্রমিক পায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কে কোন গ্রেডে পড়বে সেটি যেন নিশ্চিত করা হয়। নিলামে যদি কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি কাউকে না নেয়, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে খেলোয়াড়রা যেন নিজেদের প্রাপ্য গ্রেডে থাকে।
৪. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক ১ লাখ টাকা হতে হবে। তাদের বেতন খুবই কম। ওটা অবশ্যই ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। প্রতিটি বিভাগে খেলোয়াড়দের জিম, নেট, মাঠের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। ১২ মাস ফিজিও-ট্রেনার রাখতে হবে। এই ফিজিও-ট্রেনাররা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আনবে। যেন তারা সেভাবে কাজ করতে পারে। জানি, আজ চাইলেই এটা হবে না। তবে আগামী মৌসুমের আগে এটা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই না, প্রতিটি বিভাগের অনুশীলন ঢাকার এই একাডেমি মাঠেই হোক। আমরা চাই, প্রতিটি বিভাগ নিজেদের হোম ভেন্যুতে প্রস্তুতি নেবে। তাহলে ক্রিকেটের প্রসার হবে।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আরও অনেক ছোটখাটো বিষয় আছে। যেগুলো বিস্তারিত বলা কঠিন। তবুও কিছু বলি যেমন- বল একটা বড় সমস্যা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যে বল দেয়া হয়, সেটা মানসম্মত নয়। ওই বলে খেলে যখন আমরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে আসি, তখন অনেক কষ্টে মানিয়ে নিতে হয়।
এছাড়া, এখন দৈনিক ভাতা দেওয়া হয় ১৫০০ টাকা। আমাদের কাছে যে ফিটনেস দাবি করা হচ্ছে, তা এই টাকায় সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবে খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হয়। ভালো হোটেলে থাকতে হয়। ভালো থাকা-খাওয়ার জন্য যে টাকা লাগে সেটা দিতে হবে। ভ্রমণে এখন দেয়া হচ্ছে ২৫০০ টাকা। ধরুন, রাজশাহী থেকে একজন খেলোয়াড় যাবে দূরের আরেক ভেন্যুতে। এই ২৫০০ টাকায় বাস ছাড়া যাওয়া সম্ভব? এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যেতে বিমানে যেন চলাচল করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ভ্রমণভাতার দরকার নেই। বিমানের টিকিট যেন নিশ্চিত করা হয়।
অন্যদিকে, যে হোটেলে দল থাকবে সেখানে অবশ্যই সুইমিং পুল ও জিম থাকতে হবে। চার দিনের ম্যাচে একজন খেলোয়াড়ের ওপর অনেক ধকল যায়। সেই ধকল কাটিয়ে ওঠার সুবিধা যেন টিম হোটেলে থাকে। ১-২ তারকার হোটেলে থাকা সম্ভব নয়। যে টিম বাস দেয়া হয়, সেটাও খুবই হতাশার। যে বাসে খেলোয়াড়েরা স্বচ্ছন্দবোধ করে তেমন বাস যেন দেওয়া হয়।
৫. বিসিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ জাতীয় দলের খেলোয়াড় সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে যদি তুলনা করেন, জাতীয় দলের চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় সংখ্যা অনেক কম। সংখ্যাটা কমপক্ষে ৩০ জন করতে হবে। সেইসঙ্গে বেতনও বাড়াতে হবে। তিন বছর ধরে বেতন বাড়ানো হয় না।
৬. শুধু ক্রিকেটাররা নন, মাঠে যারা কাজ করেন, গ্রাউন্ডসম্যান, যিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে মাসে মাত্র ৫-৬ হাজার টাকা বেতন পান। একজন স্থানীয় কোচের কথা যদি বলি, আমরা নিজেরাই বাংলাদেশি কোচদের তুলে ধরতে চাই না। বিদেশি কোচের পেছনে যে টাকা ব্যয় করা হয়, তাতে আমাদের ২০ জন স্থানীয় কোচের বেতন হয়ে যায়! একটা সফরে দেখা গেল, বাংলাদেশি কোচের অধীনে খেলোয়াড়েরা ভালো করেছে। দেখা যাবে, পরের সফরে ওই কোচকে আর রাখা হচ্ছে না। আম্পায়ারিং নিয়ে সবাই অভিযোগ করি। কিন্তু তাদের তো আর্থিক নিশ্চয়তা দিতে হবে। একই কথা ফিজিও-ট্রেনারদের ক্ষেত্রেও। এটাই সঠিক সময় বিদেশিদের তুলনায় বাংলাদেশিদের গুরুত্ব দেওয়া।
৭. ঘরোয়া ক্রিকেটে আমরা দুটো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি। ৫০ ওভারের একটা লিগ খেলি। এখানে আরেকটা টুর্নামেন্ট বাড়ানো উচিত। বিপিএল দিয়ে একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলি। বিপিএলের আগ দিয়ে আরেকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হওয়া জরুরি। এতে বিপিএলে আরও ভালো করতে পারবে স্থানীয় ক্রিকেটাররা। আগে জাতীয় লিগে চার দিনের ম্যাচের সঙ্গে একটা ৫০ ওভারের ম্যাচ খেলতাম। এখন সেটা বন্ধ। আমরা চাই এটা আবার চালু হোক। যাতে আরও বেশি একদিনের ম্যাচ খেলতে পারি।
৮. ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য একটা নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার থাকতে হবে। যেটা দেখে আমরা আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারি।
৯. বিপিএল-প্রিমিয়ার লিগের পারিশ্রমিক যেন সময় মতো দেওয়া হয়। গত প্রিমিয়ার লিগে খেলা ব্রাদার্সের কাছে এখনও পারিশ্রমিক পায় খেলোয়াড়রা।
১০. নিয়ম করে দেয়া হয়েছে যে, দুটির বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলতে পারবে না খেলোয়াড়রা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যস্ততা না থাকলে যে কোনও লিগ খেলার সুযোগ দিতে হবে।
১১. ঘরোয়া ক্রিকেটের কথাই বেশি আসছে। ম্যাচের আগে অনেক সময় জেনে যাই যে, কোন দল জিতবে কোন দল হারবে। এটা খুবই দুঃখজনক। এটা ঠিক করা খুব জরুরি। এর সঙ্গে খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার জড়িত। এক ম্যাচে ভালো বলে আউট হয়ে যেতে পারে একজন ব্যাটসম্যান। কিন্তু টানা যদি আম্পায়ারের বাজে সিদ্ধান্তে আউট হই, তার ক্যারিয়ার ওখানেই শেষ হয়ে যায়। খেলোয়াড়কে উঠে আসার এই পাইপলাইনটা ভালো করা জরুরি।
পরিশেষে সাকিব বলেন, এখানে আমরা নারী দলকে যুক্ত করতে পারিনি। আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাদের যদি কোনো দাবি থাকে অবশ্যই যুক্ত করা হবে। বয়সভিত্তিক দল এখানে যোগ করছি না।
তিনি আরও বলেন, ‘যত দিন এই দাবি পূরণ করা হচ্ছে না তত দিন ক্রিকেটিয় কোনও কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছি না। দাবি মানলে আবার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে আসব। ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের জন্য আমরা ভালো পরিবেশ রেখে যেতে চাই, যারা ক্রিকেটটা এগিয়ে নেবে।’
এনএস/