ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অশুভ তৎপরতা

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)

প্রকাশিত : ১২:১৩ এএম, ২২ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার

ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় গত ২০ অক্টোবর রবিবারে ফেসবুকের একটি আপত্তিকর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কথিত তৌহিদী মুসলিম জনতার সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, শুক্রবার ১৮ অক্টোবর একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটি অবমাননাকর বক্তব্য পাওয়া যায়। যার ফেসবুকে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তার নাম বিপ্লব চন্দ্র শুভ। পুলিশের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বিপ্লব চন্দ্র শুভ শুক্রবার থানায় আসে এবং অভিযোগ করে তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে এবং তিনি নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় থানায় এসেছেন। হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের পুলিশ স্বল্প সময়ের মধ্যে আটক করতে সক্ষম হয়। আইন ও বিচারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে বিষয়টি এখানেই শেষ হতে পারত এবং রবিবারের দুঃখজনক ঘটনা এড়ানো যেত, চারজন মানুষের জীবন যেত না। 

ধর্ম অবমাননা করার অধিকার কারও নেই, তেমনি আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকারও কারও নেই। দুটোই অন্যায় এবং অপরাধ। তবে আইন হাতে তুলে নেওয়া অপেক্ষাকৃত বড় অপরাধ। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এমন কি যারা আইন প্রয়োগ ও বিচার করেন তারাও নয়। একটি ছোট অপরাধ যেমন আরেকটি বড় অপরাধের জন্ম দেয়, তেমনি একটি বড় অপরাধ অনেকগুলো বড় অপরাধের জন্ম দিতে পারে। তাই অপরাধ তা ছোট হোক আর বড় হোক সেটিকে অঙ্কুরেই শেষ করার জন্য রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদা সর্বত্র অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় থাকবে সেটাই প্রত্যাশিত। কারণ সাংবিধানিকভাবে জননিরাপত্তা রক্ষা করা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। 

ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে যাতে আইনের আশ্রয় পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনও রকম কোনও বৈষম্য হলে তা হবে মস্তবড় অপরাধ। ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে চারজন মানুষের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু না হলে এবার পুলিশসহ প্রশাসন ঘটনা সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যেভাবে রামু ও নাসিরনগরের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে, সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। 

ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার, তারপর শনিবার ও রবিবারের ঘটনাপ্রবাহ বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শুক্রবারের খবরটি থানায় আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তাতে আর বাড়াবাড়ি হওয়ার সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার কারণে রবিবারের অপ্রত্যাশিত গোলাগুলির ঘটনা ঘটে এবং তাতে চারজন নিহত হয়। তাই প্রশ্ন উঠেছে এই উগ্রবাদী কথিত তৌহিদী জনতা কারা, এদের আসল পরিচয় কি। 

তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগ বাড়িয়ে কোনো পক্ষের দিকে আঙ্গুল তুলতে চাই না। কিন্তু পূর্বে সংঘটিত একই রকম ঘটনার সূত্র ধরে বলতে চাই ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পুলিশের ওপর আক্রমণকারী ওই তৌহিদী জনতার নামের আড়ালে কারা রয়েছে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন। কারণ, এটিকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাচ্ছে না। এর আগেও দেখেছি কোটা বিরোধী আন্দোলন, ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে উছিলা ও সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে একটি পরাজয় উন্মুখ রাজনৈতিক পক্ষ কিভাবে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছে।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে নিজেদের দুর্বলতার কারণে সুবিধা করতে পারে না, তারা সর্বদা তক্বে তক্বে থাকে এবং একটি সুযোগ পেলেই তার ওপর ভর করে অপতৎপরতা চালিয়ে পানি ঘোলা করতে চায়, যদি তাতে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়িটির সন্ধান পাওয়া যায়। আর এরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে না, পরিকল্পিতভাবে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সে রকম সুযোগ তৈরি করে। ভোলার ঘটনাটি আমার কাছে এমনই মনে হয়েছে।

আরেকটু বিচার বিশ্লেষণে যাওয়া যাক। শুক্রবার পুলিশের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও একটি পক্ষ শনিবার দিন রাত জুড়ে ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন বক্তব্যসহ ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায় এবং রবিবার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঈদগাহ মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়। রামু ও নাসিরনগরে একই প্যাটার্নের সমাবেশ থেকে ভয়ানক অপ্রীতিকর ঘটনার অভিজ্ঞতায় পুলিশের পক্ষ থেকে সমাবেশ না করার আহবান জানানো হয়। কিন্তু তৌহিদী জনতার পক্ষে তৎপর হওয়া কয়েকজন স্থানীয় ধর্মীয় নেতা তাতে কর্ণপাত করে না। পুলিশের আহবান অমান্য করে তারা সমাবেশের জন্য পুরো ভোলা জেলা থেকে লঞ্চ, ট্রলার, নৌকা বোঝাই করে লোক এনে বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে রবিবার জড় করতে থাকে।

সঙ্গত কারণে বিপদ আঁচ করতে পেরে পুলিশও যথেষ্ট সতর্ক হয়। ভোলার পুলিশ সুপার নিজেই সেখানে উপস্থিত হন। অনুরোধ ও পুলিশ সুপারের বক্তব্য শুনে সমাবেশে আগত ধর্মপ্রাণ মানুষ সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যেতে শুরু করে। এমন সময় ভিড়ের মধ্য থেকে পুলিশের ওপর আক্রমণ শুরু হয় এবং ব্যাপকভাবে ইট-পাথর মারতে থাকে। কয়েকজন পুলিশ আহত হয়। বেগতিক দেখে পুলিশ সুপার নিজে তার ফোর্স নিয়ে পাশে মসজিদের ভেতর আশ্রয় নেয়। সমাবেত তৌহিদী জনতা ব্যানারের আড়ালে আগত দুর্বৃত্তরা তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে মসজিদের ভেতরে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। 

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এমতাবস্থায় আত্মরক্ষার্থে পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি চালানো হয় এবং তাতে চারজন নিহত হওয়ার খবর আসে। তারপর আগত লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যায়। মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে আগত নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন পুলিশের নেওয়া পদক্ষেপের কথা পুলিশ সুপারের মুখে শুনে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন আবার পুলিশের ওপর আক্রমণ শুরু করল কারা। আক্রমণে ব্যবহারিত এত ইট পাথর তারা কোথায় পেল। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক ফেসবুকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা নিজেদের রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি চরিতার্থ করার ষড়যন্ত্র করেছিল তারাই পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়।

আত্মরক্ষার্থে মসজিদে আশ্রয় নেওয়ার পরেও পুলিশের ওপর আক্রমণের এই ঘটনা দেখে জামায়াত শিবিরের পুরনো তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে। নব্বই দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে আন্দোলনের নামে জামায়াতের ক্যাডার বাহিনী কর্তব্যরত পুলিশের একজন সদস্যকে ঢাকার মুহাম্মদপুরের একটি মসজিদের ভেতরে টেনে নিয়ে ইটের আঘাতে মাথার ঘিলু বের করে দেয় এবং তাতে ওই পুলিশ সদস্য নিহত হয়। মসজিদের ভেতরেই তার লাশ লুকিয়ে রাখে। 

২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর এক পর্যায়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে একটি ফাঁড়িতে বিশ্রামরত পুলিশের ওপর শিবিরের ক্যাডার বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। তারপর ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত আন্দোলনের সময়ে সে বছর ৬ জানুয়ারিতে রাজশাহীর শিবির কর্মীরা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর আক্রমণ চালায়, তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্র দিয়ে বেধড়ক পেটায়। তাতে দুই পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরের দিন ৭ জানুয়ারিতে সেই চিত্র সকল পত্রিকায় ছাপা হয়। ভোলাতে এই রবিবার যেভাবে লোকজনদের লঞ্চ, ট্রলার, নৌকা ভাড়া করে বোরহানউদ্দিনে আনা হয়েছে সেটা কি অপরিকল্পিতভাবে, কোনো সুসংগঠিত সংগঠন ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্ভব?

এতে প্রয়োজনীয় অর্থ ও তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের তৎপরতা আবশ্যক। এরা কারা, এদের উদ্দেশ্য কি সেটা বোঝার জন্য কেতাব নিয়ে বসার প্রয়োজন নেই। এদেশে কারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, কারা ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ায়, কাদের এত টাকা আছে সেটি সকলেই জানেন। তাদের সঙ্গী পৃষ্ঠপোষকদেরও এদেশের মানুষ চিনে। এই সময়ে এ ধরনের একটা অপতৎপরতার উদ্দেশ্যেও বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে এবং তার সঙ্গে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ফ্রন্ট অরগেনাইজেশনে শুদ্ধি অভিযান ইত্যাদিকে ঘিরে পঁচাত্তরের পরে আবির্ভূত অপশক্তি সমাহীন প্রোপাগান্ডাসহ বহু রকম গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলার চেষ্টা করছে।

আর এই সময়েই যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো সংবেদনশীল ঘটনা ঘটে তখন সেটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। পরিকল্পিত ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে কিভাবে একটা নির্বাচিত সরকারকে বিপদে ফেলা হয় তার একটা উদাহরণ দিই সংক্ষেপে। সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালের প্রথম দিকে। বইটির ভেতরে ইসলাম ধর্মের মহানবী (সা.)কে নিয়ে কিছু আপত্তিকর কথা ছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে তা কারও নজরে আসেনি। কিন্তু পাকিস্তানে তখন ক্ষমতাসীন বেনজীর ভুট্টোকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বইটি মাওলানা কাওসার নিয়াজিকে হস্তান্তর এবং তা নিয়ে পত্রিকায় লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করে পাকিস্তানের ক্ষমতার নিয়ামক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এ নিয়ে মাওলানা নিয়াজির উত্তেজনাপূর্ণ প্রবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানসহ সারাবিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।

ইরানের ধর্মীয় নেতা খোমেনি রুশদির মাথা চেয়ে ফতোয়া জারি করে। পাকিস্তানের সমস্ত ইসলামিস্ট উগ্রবাদী দল একত্র হয়ে ১৯৮৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে ইসলামবাদে বিশাল সমাবেশের ডাক দেয়। সমাবেশের উত্তেজিত জনতা পাশে অবস্থিত আমেরিকার তথ্য কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ চালায়, আগুন ধরিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ বাধ্য হয়ে গুলি চালালে ৫ জন নিহত হয়। ফলে ধর্মীয় উত্তেজনা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত বেনজীর ভুট্টো ক্ষমতাচ্যুত হন। 

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পুনরায় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চালু হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার বহু অপচেষ্টা আমরা দেখেছি। সুতরাং সম্প্রতি ভোলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অশুভ তৎপরতাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com