শার্শার গৃহবধূ গণধর্ষণ, তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে টালবাহানা
বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০১:৩৮ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০১৯ মঙ্গলবার
পুলিশের সঙ্গে বাচ্চা কোলে গৃহবধূ এবং এসআই খাইরুল
যশোরের শার্শার আলোচিত সেই গৃহবধূ ধর্ষণ ঘটনার দেড় মাস পার হলেও আসামিদের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট পায়নি তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আটক ৩ আসামির মধ্যে দু‘জন জেলা জজ ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করলেও তাদের জামিনও মেলেনি। অন্যদিকে, অন্যতম আসামি আব্দুল লতিফ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও জবানবন্দিতে তিনি কী বলেছিলেন সে বিষয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি।
তদন্ত সংস্থা পিবিআই তার জবানবন্দি বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোন মন্তব্য না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনায় অভিযুক্ত গোড়পাড়া ক্যাম্পের তৎকালিন ইনচার্জ এসআই খায়রুল আলম ক্লোজ হওয়ার পরও বর্তমানে পুলিশ লাইনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, গত ১ সেপ্টেম্বর শার্শা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের ওই গৃহবধূর স্বামীকে আটক করেন গোড়পাড়া পুলিশ ক্যাম্পের তৎকালিন ইনচার্জ এসআই খায়রুল আলম। আটকের পর তার বিরুদ্ধে ৫০ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার দেখিয়ে থানায় মামলা করা হয়। যদিও গৃহবধূর অভিযোগ, তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ফেন্সিডিল দিয়ে মামলা দিয়েছে।
এ ঘটনার পরদিন গত ২ সেপ্টেম্বর নিজ ঘরে গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে যশোরে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খায়রুল আলম তার স্বামী যাতে সহজে জামিন পান সেই ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে তার কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। কিন্তু টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় এসআই খায়রুল আলম ও তার সোর্স কামরুল মিলে তাকে ধর্ষণ করেন।
পরে এ ঘটনা জানাজানি হলে পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। শনাক্তের জন্য পুলিশ গৃহবধূকে নিয়ে গিয়ে অভিযুক্ত এসআই খায়রুল আলমের মুখোমুখি করে। পরে শার্শা থানার তৎকালীন ওসি মশিউর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, গৃহবধূ তাকে (এসআই খায়রুল আলম) শনাক্ত করেননি। ‘এই লোক সেই লোক নয়’-গৃহবধূ এমনটা বলেছিলেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো। পাশাপাশি গৃহবধূর ডাক্তারি পরীক্ষায় চিকিৎসকরা ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন বলে রিপোর্ট দেন। তবে, সেখানে কার কার ‘বীর্য’ রয়েছে তা ডিএনএ টেস্ট ছাড়া বলা যাচ্ছে না বলে জানান যশোর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদ।
কিন্তু পরে ভুক্তভোগী গৃহবধূ নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি এসআই খায়রুল আলমকে ভালোভাবেই চেনেন। কিন্তু সেদিন (মুখোমুখির সময়) ভয়ে তার নাম বলতে পারেননি।
এদিকে গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনায় অভিযুক্ত এসআই খায়রুল আলমকে ক্লোজ করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করে কর্তৃপক্ষ। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে ওসি মশিউর রহমানকেও যশোর পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ ওঠে।
এর আগে এসআই খায়রুল আলমকে বাদ দিয়েই ৩ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে শার্শা থানায় গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় ৩ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও একজনকে আসামি করা হয়। পুলিশ এজাহারভুক্ত ৩ আসামিকে আটকও করে। এরা হচ্ছেন, লক্ষণপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে আব্দুল কাদের, আব্দুল মাজেদের ছেলে আব্দুল লতিফ ও চটকাপোতা গ্রামের মৃত হামিজ উদ্দিনের ছেলে কামরুজ্জামান কামরুল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র ইনসপেক্টর মোনায়েম হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর আদালত আটক আসামিদের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে নেওয়ার পরদিনই আটক আসামিদের মধ্যে আব্দুল লতিফ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। তার এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ঘটনায় সর্বত্র ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
কিন্তু তদন্ত সংস্থা পিবিআই ব্যাপক গোপনীয়তা রক্ষা করায় আব্দুল লতিফ জবানবন্দিতে কী বলেছেন তা আজও জানা যায়নি। ওই সময় পিবিআই’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, জবানবন্দি থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। মামলার অজ্ঞাতনামা আসামির নাম জবানবন্দিতে মিলেছে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব পিবিআই বরাবরই এড়িয়ে গেছে।
পিবিআই যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান, এখনও বলার মত সময় হয়নি। অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ইনসপেক্টর মোনায়েম হোসেনও আটক আসামি আব্দুল লতিফের জবানবন্দির বিষয়ে কোন কিছু মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পিবিআই আলোচিত ও স্পর্শকাতর এ মামলাটি সতর্কতার সাথে তদন্ত করছে বলে জানা গেছে।
যদিও আব্দুল লতিফের আদালতে দেয়া জবানবন্দি নিয়ে পিবিআই অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করায় নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইনসপেক্টর মোনায়েম হোসেন জানান, আটক ৩ আসামির ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি।
আদালত সূত্র জানায়, আটক ৩ আসামির মধ্যে আব্দুল কাদের ও আব্দুল লতিফের পক্ষ থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে ইনসপেক্টর মোনায়েম হোসেন জানান, আদালত তাদের জামিন দেয়নি।
শার্শার ওই গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ঘটনায় অভিযুক্ত এসআই খায়রুল আলমকে ক্লোজ করার পর তিনি সংযুক্ত হয়ে পুলিশ লাইনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। পুলিশ লাইনের রিজার্ভ অফিসার (আরও) এসআই তারিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, পুলিশের পক্ষ থেকে ওই সময় বলা হয়েছিলো মামলায় যাতে প্রভাব না পড়ে সে জন্য তাকে (এসআই খায়রুল আলম) প্রত্যহার করা হয়েছে।
এনএস/