ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

‘মার্ডার করিনি, চুরিও না-কাজ করে খেতে এসেছি’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:০৩ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৬:০৪ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০১৯ রবিবার

'অবৈধ বাংলাদেশি' সন্দেহে ভারতের কর্নাটক রাজ্যের পুলিশ রাজধানী ব্যাঙ্গালোর থেকে অন্তত ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। যাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। শনিবার (২৬ অক্টোবর) দিনভর শহরের বিভিন্ন বস্তিতে অভিযান চালিয়ে এই বাংলাদেশিদের আটক করা হয়। যাদের কাছে ভারতে বৈধভাবে থাকা বা কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল না বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এদিকে, রাজ্যটির বিজেপি সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, অবৈধ বিদেশিদের শনাক্ত করতে তারা কর্নাটকেও আসামের ধাঁচে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরি করতে চায়। এমনকী সেখানে একটি 'ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টার' বা বন্দী-শিবির তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে। যেখানে অবৈধ বিদেশিদের আটক রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে।

বস্তুত, আসামের পর ভারতের যে সব রাজ্যে ইদানীং কথিত অবৈধ বাংলাদেশি তাড়ানো বা এনআরসি অভিযান চালু করার হিড়িক পড়েছে, তার অন্যতম হল দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক।

রাজ্যের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাসবরাজা বোম্মাই এ সপ্তাহেই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে যারা সেখানে বেআইনিভাবে থাকছেন তাদের ডেটাবেস তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে।

বাসবরাজা বোম্মাই বলেন, "অভিবাসীদের মধ্যে কারা এখানে বৈধভাবে বা পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে আছেন আর কাদের সেসব নেই, বেআইনিভাবে এখানে আছেন, আমরা সেই তথ্য সংগ্রহ করছি।"

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, "সীমান্ত পেরিয়ে যারা দক্ষিণ ভারতে এসেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক কিন্তু ঢুকেছে কর্নাটকেই, ব্যাঙ্গালোর ও অন্যত্র তারা থাকছেন।"

"একে তো তাদের কাগজপত্র নেই, আরও উদ্বেগের বিষয় হল- তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। কর্নাটকের স্থানীয় মানুষের জীবন শান্তিতে রাখার জন্য যেটা করা দরকার, এখানে আমরা সেটাই করতে চাই", যোগ করেন তিনি।

সরকারের এই ঘোষণার চারদিনের মাথাতেই শনিবার ব্যাঙ্গালোরের মারাঠাহাল্লি, বেলান্ডার ও রামমূর্তি নগর - এই তিনটি এলাকার বস্তিগুলোয় অভিযান চালিয়ে পুলিশ অন্তত ৬০ জনকে গ্রেফতার করে। যাদের মধ্যে ২৯ জন পুরুষ, ২২ জন নারী এবং বাকি ৯ জন শিশু।

এদেরকে 'সন্দেহভাজন বাংলাদেশী' বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, কারণ পুলিশের মতে এদের বাংলা ভাষার ডায়লেক্ট নাকি পশ্চিমবঙ্গের কথ্য বাংলার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। তাছাড়া, তাদের কাছে ভোটার আইডি বা আধার কার্ডের মতো যে সব পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে, সেগুলোও নাকি জাল। 

'দ্য ফেডারেল' নামে শহরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আটক হওয়া এমনই কয়েকজন নারীর সঙ্গে পুলিশ হেফাজতেই কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল, যাদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, "আমরা এখানে মার্ডার করতেও আসিনি, চুরি করতেও আসিনি - চুরি করলে তো দেশেই করতে পারতাম। আমরা এখানে কাজ করে খেতেই এসেছি, এখন আপনারা যা-পারেন করে নিন!"

তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশে ঘুষ দিলে তবেই কাজ মেলে, আর বাপ-মার পয়সা ছিল না বলেই আমাদের সেখানে পড়াশুনো করা হয়নি।" আর সে জন্যই বিদেশ-বিভূঁয়ে কাজের সন্ধানে আসতে হয়েছে বলেও জানান ওই নারী।

ঝর্না (আসল নাম নয়) নামে আর একজন নারী জানান, স্বামী যখন কাজে বাইরে ছিলেন, তখন পুলিশ তার কোলের শিশু সমেত বাড়ি থেকে তাকে তুলে এনেছে।

ঝর্না 'দ্য ফেডারেল'কে বলেন, "খুব কম বয়সে বাবা-মার সঙ্গে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এখানেই আমার বিয়ে হয়েছে, একটা বাচ্চাও হয়েছে - তবে বাবা-মার সঙ্গে এখন কোনও সম্পর্ক নেই।

"শনিবার যখন আমার বর কাজে বেরিয়েছে, তখন বেলা এগারোটা, এ সময় পুলিশ আমাদের বস্তিতে এসে হাজির। তারপর থেকে আমাদের আর কোনও কথা হয়নি, আমার সাথে অন্য কেউ নেইও - পুলিশ এখানে ধরে এনেছে।"

"কোলের বাচ্চাটা খিদের জ্বালায় কাঁদছিল, তারপরও পুলিশ আমাকে ছাড়েনি", কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ঝর্না।

গ্রেপ্তার হওয়া এই ব্যক্তিরা বেশির ভাগই শহরের গার্বেজ বা 'ওয়েস্ট সেগ্রিগেশনে', অর্থাৎ বর্জ্যের স্তূপ থেকে ময়লা আলাদা করার কাজে যুক্ত ছিলেন। আর ব্যাঙ্গালোর পৌরসভার ঠিকাদাররাই তাদের কাজে লাগাতেন।

তবে ব্যাঙ্গালোরে বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, অবৈধ বাংলাদেশিরা কিন্তু জঙ্গী কার্যকলাপেও জড়িয়ে পড়ছে।

মাস তিনেক আগেই শহরের তরুণ বিজেপি এমপি তেজস্বী সূরিয়া যেমন লোকসভায় বলেছিলেন, "বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত একটি টেরর মডিউল ব্যাঙ্গালোরে ফাঁস হয়েছে। আর শহরের অবৈধ বাংলাদেশীরাও অনেকে তাতে জড়িত।"

তিনি তখন দাবি করেছিলেন, সারাদেশ জুড়ে বোমা হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের - আর সে কারণেই দেশের নিরাপত্তার জন্য এরা বড় হুমকি।

এই নিরাপত্তার যুক্তি দিয়েই সারাদেশে অবৈধ বিদেশি শনাক্ত করার অভিযানের পক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা চলছে - কর্নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়।

ইতিমধ্যে ব্যাঙ্গালোরের পুলিশ কমিশনার ভাস্কর রাও জানিয়েছেন, ধৃত ৬০ জনকে এখন বাংলাদেশে ডিপোর্ট করার লক্ষ্যে বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সূত্র-বিবিসি।

এনএস/