কুড়িগ্রামে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই তবু এমপিও
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
প্রকাশিত : ০৭:০৪ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০১৯ রবিবার
কুড়িগ্রামে একই ইউনিয়নে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবারে এমপিও ভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একই মালিকের ২টি প্রতিষ্ঠান এমপিও হলেও একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার আশ্বাস শিক্ষা কর্মকর্তার।
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় সদর ইউনিয়নে এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই ৪টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে একই মালিকের ২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার একটি পরিত্যক্ত ভবন থাকলেও নেই কোন শিক্ষার্থী। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী দেখিয়ে এমপিও হবার সুযোগ গ্রহণ করার অভিযোগ উঠেছে। জরাজীর্ণ আর পরিত্যক্ত এই ভবনটি দীর্ঘ ৪ থেকে ৫ বছর ধরে হাটের গরু রাখাসহ মাদকাসক্তদের অপকর্মের আস্তানা হয়ে উঠেছে। নেই দরজা, জানালা, ঘরগুলোতে রয়েছে গরুসহ খড়কুটা, গোবর এবং জুয়া খেলার সরঞ্জমাদী। কাগজ-কলমে এই প্রতিষ্ঠানের জায়গা হলেও এর অস্তিত্ব মেলে অন্যত্র।
এমপিওর তালিকায় নাম আসার পরপরই রাতারাতি সোনাহাট ইউনিয়নের ঘুন্টির মোড় নামক স্থানে অন্য প্রতিষ্ঠান উপমা মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটের নাম পরিবর্তন করে এফএ মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটের ব্যানার লাগানো হয়েছে। টিনশেড এই প্রতিষ্ঠানে নেই কোন শিক্ষার্থী, নেই ক্লাস চলার কার্যক্রম। কাগজ কলমে পরিচালনা হলেও পরিত্যক্ত এই প্রতিষ্ঠানটি এমপিও ভুক্তি তালিকায় কিভাবে গেল এ নিয়ে রয়েছে জনমনে প্রশ্ন।
অপরদিকে সদ্য এমপিও ভুক্তি হওয়ায় ২৮শতক জমিতে গড়া এফএ টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটে চলছে পরীক্ষা। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের জ্ঞ্যান ছাড়া পায়না কোন কারিগরি শিক্ষা। এই প্রতিষ্ঠানে ল্যাবসহ কম্পিউটারের সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও এমপিও হয়েছে। কাগজে কলমে স্থান ও ছাত্র-ছাত্রীর নাম ঠিকঠাক থাকলেও বাস্তবে ভিন্ন চিত্র। এখানে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এনে পরীক্ষা দেয়া হয়। এফএ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর আগে পাশকৃত অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন। একটি প্রতিষ্টানের ছাত্র-ছাত্রী দিয়ে অন্য ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে দেখানো হয়। এমপিও তালিকা যাচাই-বাছাইয়ে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে দীর্ঘদিন থেকে এমপিও ভূক্তির অপেক্ষায় থাকা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এফএ মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ মোদ্দাছেরুল ইসলাম স্বীকার করেন, এই প্রতিষ্ঠানের মূল জায়গাটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায়। তিনি আরো বলেন,আগে উপমা মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউট থাকলেও তাদের কোন শিক্ষার্থী না থাকায় এটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমরা এক বছর ধরে মাসে ১০হাজার টাকা ভাড়ায় ২৬শতক জমিতে গড়া এই টিনসেড ঘরেই এফএ মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউট পরিচালিত হচ্ছে। তার কথাতেও গরমিল পাওয়া যায়। টিনসেড এই ঘর গুলোতে ক্লাস পরিচালনার জন্য পাওয়া যায়নি কোন ব্রেঞ্চ,বোর্ড কিংবা পাঠদানের সরঞ্জামাদী। তার দাবী ক্লাস হয় নিয়মিত। এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ১৯০জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক ৪জন ও স্টাফ রয়েছে ৬জন। নিরাপত্তা জনিত কারণে এখানে কম্পিউটার ল্যাব না থাকলেও ১০টি কম্পিউটার রয়েছে।
এফএ নামে একই মালিকের ২টি প্রতিষ্ঠান থাকায় অন্য প্রতিষ্ঠানে সেগুলো রয়েছে। এই কথারও মিল পাওয়া যায়নি। তার তথ্য মতে এফএ টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটে নেই কোন ল্যাব নেই কোন কম্পিউটার। এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ পর্যন্ত কোন কারিগরি প্রশিক্ষনের ক্লাসই করেননি। এফএ টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ আল-মামুন ল্যাব ও কম্পিউটার না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে আসা হচ্ছে। এখানে সরকারি বা বেসরকারি কোন অনুদান আমরা পাইনি এবং নেইনি। এখন এমপিও হয়েছে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। ঘনবসতি এলাকায় ২৮শতক জমিতে স্থাপিত এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ৪৫০জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক আছে ১২জন।
স্থানীয় বাসিন্দা, বুলবুলি, রবিউল, মন্টু ব্যাপারি বলেন, এফএ মহিলা টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটের নামে কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তবে বছর ৫আগে এখানে এফএ টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউট ছিল। সেটিও ছাত্র-ছাত্রী না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক ফেরদৌসুল আরেফিন সে নিজেও এমপিও ভুক্ত দিয়াডাঙ্গা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। সে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে রংপুর এবং ভূরুঙ্গামারীতে। নতুন এমপিও স্বীকৃতি পাওয়া প্রতিষ্ঠান গুলোতে তারই নিজের ছোট ভাই ও চাচা অধ্যক্ষ হিসেবে রয়েছেন।
আবেগ আপ্লুতে কন্ঠে এই রিয়াজুল শিক্ষক জানালেন, ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার খেসারত দিতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের ত্যাগি শিক্ষকদের। তারা দীর্ঘদিন ধরে এমপিওর আশায় থাকলেও নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে এবার এমপিও।
এফএ টেকনিক্যাল এন্ড আইটি ইন্সটিটিউটের মালিক ফেরদৌসুল আরেফিন পরিত্যক্ত ভবনের কথা স্বীকার করে বলেন, কাগজ পত্র সব ঠিকঠাক রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এনে ভর্তি দেখানো হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো কখনই শতভাগ দেখানো সম্ভব নয়। তবে যখন পরিদর্শনে আসে তখন সেগুলোই দেখানো হয়। তার দাবী এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য তিনি একাধিক প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। এরমধ্যে তার কর্মরত প্রতিষ্ঠানটি আগেই এমপিও ছিল। এবারই তার নিজের ২টি প্রতিষ্ঠান এমপিও হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এক কিলোমিটারের মধ্যে বলতে কোন বিধি নেই। একই উপজেলায় সর্বোচ্চ ৬টি প্রতিষ্ঠান এমপিও হতে পারে।
জেলা শিক্ষা অফিসার শামছুল আলম বলেন,জেলায় ১৯টি মাধ্যমিক ও নি¤œমাধ্যমিক বিদ্যালয়,৬টি মাদ্রাসা এবং ১০টি এসএসসি বিএম প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তি হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী চারটি শর্ত পূরণ করলে এমপিও পাওয়া যায়। শর্ত গুলো হল- প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির মেয়াদ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পাসের হারের ভিত্তি অনলাইনে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এমপিও হবার আবেদন করেছেন। তিনি স্বীকার করেন,জেলায় এখনও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যাদের যোগ্যতা থাকার পরেও এমপিও হয়নি। তবে এমপিও চলমান প্রক্রিয়া সেহেতু পর্যায়ক্রমে হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আর অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অনলাইনে কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকলেও সরকার বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে পুর্ণবিবেচনা করবেন এবং ব্যবস্থা নেবে বলেন জানান তিনি।
গত ২৩অক্টোবর ঘোষিত এমপিও তালিকা অনুযায়ী এইচএসসি বিএম কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় ৪০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্তি হয়েছে। এরমধ্যে ভূরুঙ্গামারীতে-৫টি,চিলমারী-২টি, উলিপুর,রাজারহাট, এবং রৌমারীতে ১টি করে। মাদ্রাসা আলিম স্তর নাগেশ্বরী,রাজিবপুরে ১টি করে। মাদ্রাসা দখিল স্তর সদর, ভূরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ি, রাজারহাটে ১টি করে। মাধ্যমিক স্তর রৌমারীতে-৭টি,ভূরুঙ্গামারী ও উলিপুরে-২টি করে, চিলমারী, রাজিবপুর, রাজারহাট এবং সদরে- ১টি করে। নিম্ন মাধ্যমিক স্তর রৌমারীতে-২টি। উচ্চ মাধ্যমিক (স্কুল এন্ড কলেজ) ফুলবাড়িতে ১টি। উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) নাগেশ^রী-১টি। কৃষি প্রতিষ্ঠানে রাজারহাট, উলিপুর, রৌমারীতে ১টি করে। ভোকেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রৌমারীতে-২টি।
আরকে//