চারঘাটে একাত্তরের বিতর্কিত ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে তদন্ত
রাজশাহী প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০৫:৫৬ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০১৯ বৃহস্পতিবার
একাত্তরে যার বিরুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুম করার অভিযোগ রয়েছে, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর সন্তানেরা তার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র জোগাড় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নাজুমল হক অভিযোগের তদন্ত করেছেন। গত মঙ্গলবার ইউএনও তার কার্যালয়ে এ বিষয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন।
অভিযুক্ত এই মুক্তিযোদ্ধার নাম গোলাম রহমান। তার বাড়ি চারঘাট উপজেলার ডাকরা গ্রামে। তিনি মারা যাওয়ার পর ২০১১ সালে তার ছেলেরা বাবার মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় করেছেন। এই খবর শোনার পর স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং ওই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা চমকে উঠেছেন। এ নিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দেয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, গোলাম রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। সে সময় একদিনের জন্যও ভারতে যাননি।
মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় সংগঠক ও আওয়ামী লীগ কর্মী আজব আলীর বয়স এখন ৭৭ বছর। তিনি সাক্ষ্য দিতে এসে সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেননি। বরং শামসুল আলম নামের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে তার লাশ গুম করেছেন। সেই লাশ আর পাওয়া যায়নি। একই কথা বলেন ৮৫ বছরের আবুল কাশেমও। সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন মুক্তিযোদ্ধার ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৬০), স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী ইউসুফ আলী (৫৫) ও শাহজামাল (৬০)। তারা প্রত্যেকেই অভিযোগ করেছেন গোলাম রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেননি।
কেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানতে চাইলে তারা বলেছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাক, তারাই মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাক, কোনো অমুক্তিযোদ্ধা যেন এই সনদ না পায়। এটা দেশের জন্য কলঙ্ক। এই কলঙ্ক মোছনের জন্যই তারা অভিযোগ করেছেন।
এতদিন পরে কেন অভিযোগ করেছেন জানতে চাইলে তারা বলেছেন, গোলাম রহমান মুক্তিযোদ্ধা এটা এলাকার কোনো মানুষ জানত না। অল্প কিছুদিন থেকে তারা জানতে পেরেছেন যে, তার ছেলেরা বাবার মৃত্যুর পর বাবার মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করেছেন এবং সেই সনদ বলে তারা ভাতা পাচ্ছেন। ছেলেদের চাকরি হচ্ছে। এরপর থেকে তারা একের পর এক অভিযোগ দেওয়া শুরু করেছেন। কিন্তু এতদিন কোনো তদন্ত হয়নি। হঠাৎ এবার তারা তদন্তের চিঠি পেয়েছেন।
গোলাম রহমানের মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়া হলেও ২০১২ সালের ১৭ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চারঘাটের ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন সংসদ থেকে দেয়া একটি প্রত্যয়নপত্রে বলা হয়, গোলাম রহমানের ছেলে আবু ফয়সাল বিপুল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নন। প্রত্যয়নপত্রে ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন সংসদের তৎকালীন আহ্বায়ক আমজাদ আলী ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহকারী কমান্ডার (সাংগঠনিক) আজিজুর রহমান স্বাক্ষর করেন।
একই বছরের ২২ জুলাই ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ প্রামানিক এক প্রত্যয়নপত্রে গোলাম রহমানের চার ছেলের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে লেখেন তারা কোনোক্রমে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নন। একই বছর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক চিঠিতে গোলাম রহমানের চার ছেলের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তাদের বাবা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবেও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তাই তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটার কোনো সুবিধা ভোগ করার অধিকারী নন।
তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগের তদন্তকালে গোলাম রহমনের ছেলে আবু ফয়সাল বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে আবেদন করে সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র পেয়েছেন। যারা অভিযোগ করেছেন তারা স্থানীয় বিরোধের কারণেই অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগ সত্য নয়। বাবার মৃত্যুর আগে কেন সনদপত্র পাননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, সনদ চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না। তার বাবার পরেও অনেকেই এই সনদ পেয়েছেন।
চারঘাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার মিজানুর রহমান দাবি করেছেন তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই গোলাম রহমানকে সনদ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। সেই সময় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, সেই সময় তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সেই সূত্রে তার সম্পর্ক থাকতে পারে। প্রকাশ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এ রকম সম্পর্ক রেখেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন।
চারঘাটের ইউএনও নাজুমল হক বলেন, এই মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ পেয়েছেন। সে বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। এই সময়ে কোনো মন্তব্য করা যায় না। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।
আরকে//