ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে সাগরের ঘর

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:১৫ পিএম, ৪ নভেম্বর ২০১৯ সোমবার

চারপাশে নীল স্বচ্ছ পানির সাগর। মধ্যখানে এক টুকরো স্থির স্থল সীমা। বিশাল সমুদ্র যেন এখানে বাসা বেঁধেছে। বিশাল জলসীমার আশ্রয়স্থল যেন এই এক টুকরো দ্বীপ। সাগরের মুখও বলা চলে তাকে। নাম তার সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা দারুচিনি দ্বীপ বা নারিকেল জিঞ্জিরা। মাটির দ্বীপও নয় এটি। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের সীমা, পৃথিবীর একদম শেষ সীমা। একটি প্রবাল দ্বীপ। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মায়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। একুশে টেলিভিশনের পাঠকদের জন্য এ দ্বীপের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হলো। 

দ্বীপটি সমতল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩.৬ মিটার উপরে। দ্বীপটি আয়তন ৯.৬৬ কিলোমিটার। দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের উন্মুক্ত সাগরের তুলনায় অনেক অগভীর। এখানে পশ্চিম-উত্তর পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর। ভৌগলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তরাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তর পাড়া এবং এ অংশ ২,১৩৪ মিটার দীর্ঘ ও ১,৪০২ মিটার প্রশস্ত।

দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশটি দক্ষিণ পাড়া হিসেবে পরিচিত, যা ১৯২৯ মিটার দীর্ঘ এবং এর সাথে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ পূর্ব দিকে বিস্তৃত একটি সংকীর্ণ লেজের মতো এলাকা, যার সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ৯৭৫ মিটার। একটি সংকীর্ণ কেন্দ্রীয় অঞ্চল বা মধ্য পাড়া দুইটি অংশকে সংযুক্ত করেছে। বেল্ট বা ফিতার মতো এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ যথাক্রমে ১৫২৪ মিটার ও ৫১৮ মিটার এবং সংকীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপটি ৭.৩১৫ কিমি দীর্ঘ এবং উত্তর-উত্তরপশ্চিম এবং দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিক জুড়ে বিন্যস্ত।

মূল দ্বীপ ছাড়াও এখানে কয়েকটি ১০০ থেকে ৫০০ বর্গ মিটার আয়তন বিশিষ্ট ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া নামে অভিহিত করা হয়, যার অর্থ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। উত্তর পাড়ার মাঝামাঝি অঞ্চলে একটি অগভীর উপহ্রদ রয়েছে এবং জোয়ারের সময় পশ্চিম তীরের একটি সংকীর্ণ নদীখাতের মাধ্যমে এটির সাথে সমুদ্রের সংযোগ ঘটে। উত্তর পাড়ার পৃষ্ঠমৃত্তিকা গঠিত হয়েছে বালি এবং ঝিনুক শামুকের খোলস সহযোগে। দক্ষিণ পাড়া অঞ্চলে রয়েছে দুটি ক্ষুদ্র মৃত উপহ্রদ এবং একটি বিস্তৃত জলাভূমি। মাছ সংগ্রহস্থল, বাজার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শুধুমাত্র উত্তর পাড়াতেই অবস্থিত।

এ দ্বীপের সঠিক ইতিহাস বলা মুশকিল কেননা পরিষ্কারভাবে এর ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে জানা যায়, প্রথম কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। তারা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিতে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতেন। তখন দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই পরিচিত ছিল। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসেন। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবি। 

প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার এমনটি জানা যায়। তারা দ্বীপের উত্তরাংশকে বসবাসের জন্য বেছে নেন। 
আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। বাঙালি জেলেরা ঝড় ও জলচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে এখানে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ রোপণ করেছিলেন। দ্বীপটি এক সময় ‘নারকেল গাছ প্রধান’ দ্বীপে পরিণত হয়। দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তা নেই। তবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে কেওড়ার ঝোপ-ঝাড় আছে। দক্ষিণ দিকে কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেয়া, শ্যাওড়া, সাগরলতা, বাইন গাছ।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল দ্বীপটিকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। তখন স্থানীয় নামের পরিবর্তে খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্ট মার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন জানান, ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। দ্বীপটিতে খ্রিষ্টান জনবসতি এবং কোন গীর্জা না থাকায় একজন সাধুর নামে দ্বীপটির নামকরণ সঠিক ইতিহাস নয় বলেই মনে হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নামে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়েছিলো।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সংঙ্গে টেকনাফের যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে নিয়মিত লঞ্চ/সী ট্রাক ও দেশী নৌকার চলাচল। দ্বীপের অধিবাসীর সংখ্যা ৩৭০০ এবং এদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী। মৎস্যজীবী পরিবারের সংখ্যা ৫৩৫। দ্বীপে ১৮২টি বন্য জীব প্রজাতির অস্তিত্ব চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪টি প্রজাতি উভচর গোত্রের, ২৮টি  সরীসৃপ, ১৩০টি পাখি এবং স্তন্যপায়ীর সংখ্যা ২০। দ্বীপের উত্তরাংশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস পর্যটন কাল। সমস্ত দ্বীপে স্বাদু পানির অভাব রয়েছে। শুধুমাত্র অল্প কিছু পুকুর এবং কিছু সংখ্যক নলকূপের মাধ্যমে সমগ্র দ্বীপে পানীয় জল এবং চাষাবাদের জন্য স্বাদু পানি সরবরাহ করা হয়।

যদিও দ্বীপটি মৌসুমি বায়ু অঞ্চলের আওতায় পড়েছে। জলবায়ু সমুদ্র দ্বারা অধিক মাত্রায় প্রভাবিত। প্রধান গাছপালার মধ্যে রয়েছে নারিকেল, সুপারি এবং বাঁশ। দ্বীপজুড়ে রয়েছে প্রচুর নারিকেল গাছ এবং জিনজিরা এলাকায় এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। দ্বীপের মৃত্তিকা খুব একটা উর্বর নয়। প্রধান ফসল পিঁয়াজ, তরমুজ এবং কিছু পরিমাণ ধান।

সেন্ট মার্টিনস চুনাপাথর, ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট কোকুইনা স্তর এবং প্রবালগুচ্ছ (প্রবাল সৃষ্ট চুনাপাথর) দ্বারা গঠিত। অত্যন্ত প্রবেশ্য এবং রন্ধ্রযুক্ত হওয়ার জন্য ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট চুনাপাথর যেখানে পলল স্তরের নিচে সঞ্চিত হয় সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ জলস্তরের সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক সামুদ্রিক বালি এবং ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট চুনাপাথর স্বাদু পানির প্রধান উৎস।

সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। তবে কিছু কিছু বালিয়াড়ি দেখা যায়। এ দ্বীপটির প্রধান গঠন উপাদান হলো চুনাপাথর। দ্বীপটির উত্তর পাড়া এবং দক্ষিণ পাড়া দু’জায়গারই প্রায় মাঝখানে জলাভূমি আছে। এগুলো মিঠা পানি সমৃদ্ধ এবং ফসল উৎপাদনে সহায়ক। দ্বীপটিতে কিছু কৃষি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।

স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত অ্যালগি এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্ট মার্টিন্সে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে তবে লাল অ্যালগি বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্যাসী শিল কাঁকড়া, লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল,রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ,উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।

এমএস/