ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

সঞ্জয় খানের অত্যাচারে ডান চোখ হারান জিনাত আমান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৫৯ পিএম, ৬ নভেম্বর ২০১৯ বুধবার

সাংবাদিক হিসেবেই তিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে পথবদল করে চলে আসেন বিনোদন জগতে। স্টাইল এবং ফ্যাশনের সংজ্ঞা তিনি নতুন করে লিখেছিলেন।‘জিনাত আমান’ নামটাই বলিউডের অভিধানে কেতাদুরস্তের সমার্থক।

জিনাতের জন্ম ১৯৫১ সালে, মুম্বইয়ে। তাঁর মা সিন্দা বর্ধিনী কারভস্তে ছিলেন মরাঠি ব্রাহ্মণ। বাবা আমানুল্লাহ খানের পারিবারিক শিকড় ছিল আফগানিস্তানে। ‘পাকিজা’ ও ‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিতে তিনি কাজ করেছিলেন চিত্রনাট্যকার হিসেবে। ‘আমান’ ছদ্মনামে তিনি লিখতেন। সেই নাম-ই পরে জিনাত ব্যবহার করতেন নিজের পদবি হিসেবে।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন জিনাত। তাঁর মা এরপর এক জার্মান নাগরিককে বিয়ে করে জার্মানির নাগরিকত্ব পান।

জিনাতের পড়াশোনা পঞ্চগনির একটি আবাসিক স্কুলে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য লস অ্যাঞ্জেলস পাড়ি। গন্তব্য ছিল সাদার্ন ক্যালিফর্নিয়া ইউনিভার্সিটি। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করেই ফিরে আসেন ভারতে। সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন ‘ফেমিনা’ পত্রিকায়।

সেখান থেকেই চলার পথ বদল। সাংবাদিকতা থেকে চলে এলেন মডেলিং-এ। ‘মিস ইন্ডিয়া’ কনটেস্টে তৃতীয় স্থান পেলেন। ১৯৭০ সালে মিস এশিয়া প্যাসিফিক-এ বিজয়িনী জিনাত-ই। এরপর সাংবাদিকতা ছেড়ে পুরোপুরি চলে এলেন বিনোদন জগতে।

প্রথম ছবি ১৯৭১ সালে। ছোট ভূমিকায় অভিনয় করলেন ‘হালচাল’ ছবিতে। সে বছরই মুক্তি পায় তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘হাঙ্গামা’। কিন্তু বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে দু’টি ছবি-ই।

হতাশ জিনাত ভেবেছিলেন অভিনয় ছেড়ে মাল্টা চলে যাবেন। থাকবেন মা এবং সৎ বাবার সঙ্গে। কিন্তু পরিকল্পনা পাল্টে দিল দেব আনন্দের একটা ফোনকল। দেব আনন্দ জিনাত-কে ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ দেন।

এই ভূমিকায় প্রথমে অভিনয় করার কথা ছিল জাহিদার। কিন্তু তিনি অফার ফিরিয়ে দেওয়ায় সেই সুযোগ পান জিনাত আমান। ছবিতে আর ডি বর্মনের সুরে ‘দম মারো দম’ গানের সঙ্গে জিনাতের পারফরম্যান্স বলিউডের ইতিহাসে আইকনিক হয়ে যায়।

এই ছবির অসামান্য সাফল্যের পরে দেব আনন্দ-জিনাত জুটি বেশ কিছু ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। ‘হীরা পান্না’, ‘ইশক ইশক ইশক’, ‘প্রেম শাস্ত্র’, ‘ডার্লিং ডার্লিং’-এর মতো সফল ছবির নাম একে একে যোগ হয় তাঁদের যুগলবন্দির তালিকায়।

এরপর ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় ‘ইয়াদোঁ কি বারাত’। ছবিতে গিটার হাতে জিনাত এবং আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে জো দিল কো’ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

দেব আনন্দ ছাড়াও জিনাত সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন বি আর চোপড়া, রাজ কাপূর, মনমোহন দেশাই, ফিরোজ খান, নাসির হুসেন, মনোজ কুমার, প্রকাশ মেহরা, শক্তি সামন্তের মতো পরিচালকদের সঙ্গে।

১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় রাজ কাপূরের ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। ছবিতে স্বল্পবসনা জিনাতকে দেখে তীব্র সমালোচনা হয়। বিতর্কিত এই ছবির জন্য একইসঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত হন নায়িকা জিনাত।

বলিউডে সাফল্য এল জিনাতের হলিউড অভিযান কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘শালিমার’। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন হলিউডের শিল্পীরাও। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একসঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। কিন্তু চূড়ান্ত ব্যর্থ হয় বক্স অফিসে।

হলিউডে পা রাখতে না পারলেও বলিউডে জিনাত-যুগ বজায় ছিল দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে। ‘হীরালাল পান্নালাল’, ‘চোর কে ঘর চোর’, ‘কুরবানি’, ‘দোস্তানা’, ‘ডন’-এর মতো ছবি তাঁর কেরিয়ার উল্লেখযোগ্য।

বলিউডে নায়িকাদের পরিচিত ইমেজ ভেঙে দিয়েছিলেন জিনাত। তিনি দেখিয়েছিলেন, পশ্চিমী পোশাকেও নায়িকা হওয়া যায়। নায়িকা মানেই শাড়িতে সুন্দর, এই মিথ চলে গিয়েছিলে তাঁর দৌলতে। কিন্তু যাঁর আবেদনে পাগল হয়ে গিয়েছিল কয়েক প্রজন্মের দর্শক, তিনি নিজে কিন্তু দাম্পত্যে ছিলেন চরম অসুখী।

শোনা যায়, কেরিয়ারের শীর্ষে থাকতেই ১৯৭৮ সালে জিনাত বিয়ে করেছিলেন সঞ্জয় খানকে। তখন সঞ্জয়ের প্রথম বিয়ের বয়স-ই পেরিয়েছে ১২ বছর। কিন্তু সঞ্জয়ের প্রেমে পাগল ছিলেন জিনাত। সব জেনেশুনেই বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মোহ এবং ভুল, সব ভাঙল কয়েক মাসের মধ্যেই।

মাত্র এক বছরেই শেষ হয়ে যায় জিনাতে প্রথম দাম্পত্য। অভিযোগ, জিনাতকে সন্দেহ করতেন সঞ্জয়। দমবন্ধ করা সেই সম্পর্কে মানসিক নির্যাতন আর নিতে পারছিলেন না জিনাত। কিন্তু সরে এলেও সঞ্জয়কে তিনি মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। তার মাসুলও তাঁকে দিতে হয়েছিল।

১৯৮০ সালে জিনাতকে মুম্বইয়ের (তখন বম্বে) এক হোটেলে ডেকে পাঠান সঞ্জয়। কথা ছিল, আলোচনা করবেন ছবি নিয়ে। কিন্তু অভিযোগ, হোটেলের বন্ধ ঘরে জিনাতকে অকথ্য মারধর করেন সঞ্জয়। সঞ্জয়ের প্রথম স্ত্রী জারিন এব‌ং আরও কয়েক জনের সামনেই চলেছিল শারীরিক নির্যাতন।

অভিযোগ, শেষে জিনাতের চিৎকার শুনে দরজা ভেঙে তাঁকে উদ্ধার করেন হোটেলকর্মীরা। আহত জিনাতের মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি। বরাবরের জন্য ‘লেজি আই’ হয়ে যায় সেটি। জীবনের এই বিতর্কিত পর্ব নিয়ে মুখে কুলুপ সঞ্জয় খানের।

তবে এই নিয়ে কোনওদিন পুলিশে অভিযোগ জানাননি জিনাত। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার বলেছেন, ওই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা তিনি ভুলে যেতে চান। তিনি ভুলতে চেয়েছেন মাজহার খানের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় দাম্পত্যও।

স্বল্প পরিচিত অভিনেতা মাজহার খানকে জিনাত বিয়ে করেন ১৯৮৫ সালে। জিনাতের অভিযোগ, মাজহারের হাতেও নিয়মিত নির্যাতিত হতেন তিনি। মাদকাসক্ত মাজহার চূড়ান্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৯৯৩ সালে। এক সাক্ষাৎকারে জিনাত জানান, এরপর পাঁচবছর তিনি সবকিছু ছেড়ে মাজহারের সেবা করেছিলেন। তিক্ত অতীত ভুলে গিয়েই দুঃসময়ে স্বামীর পাশে ছিলেন।

অগ্ন্যাশয়ের জটিল রোগে ১৯৯৮ সালে মারা যান মাজহার। জিনাতের অভিযোগ, এরপরেও মাজহারের পরিবার তাঁকে গ্রহণ করেনি। বরং চেষ্টা করেছিল দুই ছেলেকে জিনাতের থেকে সরিয়ে নিতে।

২০১৩ সালে শোনা গিয়েছিল জিনাত আবার বিয়ে করতে চলেছেন সাঁইত্রিশ বছর বয়সী এক ব্যবসায়ীকে। মুম্বইয়ের ওই যুবকের সঙ্গে জিনাত নাকি লিভ ইন-ও করছিলেন। কিন্তু পরে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন জিনাত। তিনি আবার ফিরতে চলেছেন বড় পর্দায়। আশুতোষ গোয়াড়িকরের পরিচালনায় ‘পানিপথ’ ছবিতে জিনাতকে দেখা যাবে সাকিনা বেগমের ভূমিকায়।

এসি