ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

হুমায়ূন আহমেদের আজব চিন্তা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:২২ পিএম, ৮ নভেম্বর ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৪:৩৮ এএম, ১৯ জুলাই ২০২০ রবিবার

বিশ শতকের জনপ্রিয় বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ। তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক বলে গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তিনি আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোনা মহুকুমার মোহনগঞ্জে তার মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিক।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের তরুণদের চিন্তা-চেতনা, জীবন-যাপন, সংলাপ, উচ্চারণ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রোমান্স, পরিণয়, পরস্পরে মানবিক সম্পর্ক, প্রেম-ভালোবাসা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস তুলে এনেছেন অত্যন্ত নিপুণ শিল্পীর আঁচড়ে। এছাড়াও, কখনও কখনও তার মাঝে আজব আজব চিন্তার উদ্ভব ঘটতে দেখা গেছে।

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি প্রকাশক মাজহারকে বলেন, ‘মাজহার, বাংলাদেশে ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের ব্যাপারটা আমি কিন্তু ফাইনাল করে ফেলেছি। চিকিত্সার জন্য এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে অযথা কষ্ট করার কোনও মানে হয় না। তুমি চিন্তা করে দেখ, দেশে সমস্ত কাজ-কর্ম আত্মীয়-স্বজন ফেলে হাজার হাজার মাইল দূরে আমরা কেন আসব? এখানে এসে বাড়ি ভাড়া করা, সংসার সাজানো কী পরিমাণ ঝামেলা তুমি ভেবে দেখেছ?

হুমায়ূন আহমেদ বলেন, এখন আমার পরিকল্পনাটা শোন, তিনজন ভিক্ষুকের কাছ থেকে প্রথমে ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের জন্যে অর্থ ভিক্ষা নেওয়া হবে। এদের ছবি তুলবেন নাসির আলী মামুন। স্কেচ করবেন ও ইন্টারভিউ নেবে মাসুক হেলাল। তারপর আমরা যাব বাংলাদেশের তিন শীর্ষ ধনী মানুষের কাছে। ভিক্ষুকরা দান করেছে শুনে তারা লজ্জায় পড়ে কী করেন আমার দেখার ইচ্ছা।

‘শীর্ষ ধনীর পর আমরা যাব তিন রাজনীতিবিদের কাছে। তারা কিছুই দেবেন না আমরা তা জানি। তারা কেবল নিতে জানেন, দিতে জানেন না। তবে আমার ধারণা খালি হাতে তারা আমাদের ফেরাবেন না, অনেকগুলো উপদেশ দেবেন। আমাদের উপদেশেরও প্রয়োজন আছে কি বলো?’

কিন্তু তিনজন ভিক্ষুক, তিনজন ধনী আর তিনজন রাজনীতিবিদ কেন? এ বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, পিথাগোরাসের মতে তিন হচ্ছে সবচেয়ে রহস্যময় সংখ্যা। এটি একটি প্রাইম নাম্বার। তিন হচ্ছে ত্রিকাল-অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল। তিন হল ট্রিনিটি। তিন মানে আমি, তুমি ও সে।

বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়কর যাদুকরের স্ত্রী ও অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনকে বলেন, হুমায়ূন আহমেদকে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল। তখন তিনি আফসোস করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, আমাদের দেশে একটা ক্যানসার হাসপাতাল করা দরকার। তখন তিনি ক্যানসার হাসপাতাল নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। আমি বিশ্বাস করি, তিনি যদি সময় পেতেন তাহলে ক্যানসার হাসপাতাল করার জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়ার সাহস দেখাতেন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা বিচিত্র সব চরিত্র অসংখ্য মানুষকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, স্বপ্নে ভাসিয়েছে। এক একটি চরিত্র পাঠক-দর্শকদের কাছে একেকটি নতুন আবিষ্কার। সাহিত্যের চরিত্রগুলোই বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে তার নাটক-সিনেমায়। হুমায়ূনের গড়া এসব চরিত্রে কখনো কখনও তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের প্রতিরূপ।

শাওন বলেন, হুমায়ুন আহমেদ যখন যে চরিত্রটা লিখতেন তিনি তখন সেই অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যেতেন। এই অদ্ভুত ক্ষমতা তার ছিল।

হুমায়ূনের বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সুবিধা তা হচ্ছে, পড়ার মধ্যে একটা আনন্দ পাওয়া যায়। তার লেখার সহজ ভঙ্গি পাঠকরা পছন্দ করে। এছাড়া, তার লেখার মধ্যে এক ধরনের পাগলামো আছে… অনুভূতিপ্রবণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এই পাগলামো দেখা যায়। অধিকাংশ মানুষের জীবনেই চারিত্রিক অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়।… আসলে একটা বিষয় সত্য যে একজন মানুষ একটি পর্যায়ে নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো একা হয়ে যেতে চায়। হুমায়ূনের প্রায় লেখাতেই এই নিঃসঙ্গ, একা বিচিত্র মানুষটির সন্ধান পাওয়া যায়।

মিসির আলি, হুমায়ূন আহমেদ এর সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় রহস্যময় চরিত্র। মিসির আলি কাহিনীগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির আলির কাহিনীগ‌ুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা ‘ক্রাইম ফিকশন’ বা ‘থ্রিলার’-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচণ্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা। বরং অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প বলা চলে।

চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি হিমু চরিত্রটির পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির তাড়নায়, অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশ‌ুদ্ধ যুক্তি। এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে। সেসব কাহিনীর প্রতিফলন ঘটেছে মিসির আলি সম্পর্কিত প্রতিটি উপন্যাসে।

এমবি//