পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’র তাৎপর্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:১৫ এএম, ১০ নভেম্বর ২০১৯ রবিবার
আমাদের প্রিয় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সুবহে সাদিকের সময় জন্মগ্রহণ করেন। আবার ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখই তিনি পরলোক গমন করেন। রাসূল (সা.) জন্মদিন স্মরণে প্রতিবছর রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখ পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ পালন হয়ে আসছে। এ দিনের সম্মানার্থে সরকারিভাবে অফিস-আদালতও বন্ধ রাখা হয় এবং মহানবীর জীবনী নিয়ে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে আলোচনা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজনও করা হয়।
ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ খুশী বা আনন্দ উৎযাপন করা। আর মিলাদ অর্থ জন্ম, আন-নবি অর্থ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ বলতে নবীজীর আগমনের খুশী উদযাপনকে বুঝায়। সুতরাং অশান্তি আর বর্বরতায় ভরপুর সংঘাতময় আরবের বুকে আধারের বুক চিড়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি নিয়ে এসে মানবজাতিকে সত্যের, সভ্যতা ও ন্যায়ের দিক নির্দেশনা দিয়ে গোটা বিশ্বকে শান্তিতে পরিপূর্ণ করে তুলেন। তাই মুসলিম সমাজ নবীজীর পবিত্র শুভাগমনতে খুশী মনে উদযাপন করে আসছে।
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ নিয়ে পবিত্র কোরআনুল কারীমের সূরা আল-ইমরান, ৮১-৮২ নং আয়াতে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন- হে প্রিয় রাসূল! আপনি স্মরণ করুন ওই দিনের ঘটনা (রোজে আজলের সময়ের) যখন আমি (আল্লাহ) আম্বিয়ায়ে কেরামগণের কাছ থেকে এভাবে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, যখন ‘আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং হিকমত’ অর্থাৎ নবুয়ত দান করবো, অতঃপর তোমাদের কাছে এক মহান রাসূলের শুভাগমন হবে। যিনি তোমাদের প্রত্যেকের নবুয়তের সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা সকলে অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করবে এবং সর্বোত্তমভাবে তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তোমরা কি এ কথার অঙ্গীকার করছো এবং অঙ্গীকারে কি অটল থাকবে? সমস্ত নবীগণ বললেন- হ্যাঁ, আমরা অঙ্গীকার করলাম। আল্লাহ তায়ালা বললেন- তোমরা পরস্পর স্বাক্ষী থেকো এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে স্বাক্ষী রইলাম। এরপরেও যে কেউ পিছপা হয়ে যাবে, তারা হবে ফাসেক।
এই আয়াতে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ নবীজীর আগমন সম্পর্কে রোজ আজলের মধ্যে সমস্ত নবীগণকে উপস্থিত রেখে আলোচনা করেছেন। আল্লাহপাক সব নবীগণকে মহান রাসূলের উপর ঈমান আনয়নের কথা বলেছেন এবং প্রত্যেক নবীর নবুয়তের সত্যায়নের ভারও দিয়েছেন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর। তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো নবীর তুলনা হবে না।
মানুষ যখন কোনো নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্ত হয়, তখন তার জন্য আনন্দ উৎসব করা তার স্বভাবগত কাজ। আল্লাহর নির্দেশও তাই। পবিত্র
কোরআনে আল্লাহপাক এরশাদ করেন- হে মানবকূল তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং অন্তর সমূহের বিশুদ্ধতা, হেদায়াত এবং রহমত ঈমানদারদের জন্য। হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি বলুন! আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া প্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের সমস্ত ধন দৌলত সঞ্চয় অপেক্ষা শ্রেয়। (সূরা ইউনুছ, আয়াত ৫৭-৫৮)।
সামান্য জাগতিক নিয়ামত লাভ করলে তার জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা পবিত্র কোরআন মাজীদে দেখতে পাই। ঈসা (আঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহ! হে আমাদের রব, আমাদের উপর আকাশ থেকে খাদ্য খাঞ্চা অবতরণ করুন, যা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী সবার জন্য ঈদ হবে এবং আপনারই নিদর্শন হবে, সুতরাং আমাদেরকে রিযিক দান করুন। আর আপনিই তো হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিক দাতা। (সূরা মায়েদা, আয়াত ১১৪)।
এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে খাঞ্চাভরা খাদ্য আসলে তা যদি হযরত ঈসা (আঃ)-এর ভাষায় পূর্ব ও পরবর্তী
সবার জন্য আনন্দ, উৎসবের কারণ ও আল্লাহর নিদর্শন হয় তাহলে সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম সত্ত্বা, রহমতের ভান্ডার, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মত মহান নিয়ামতের শুভাগমনের দিন কতইনা মর্যাদাবান, গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের দিন বা মাস তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ পালন করার রীতি ছিল। এ সম্পর্কে আল্লামা শাহাবুদ্দীন ইবনে হাজর হায়তামী (রহ.) বলেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করার নীতি প্রচলন ছিল। আন নে’মাতুল কোবরা আলাল ফি মাওলিদি সাইয়্যেদ ওলদে আদম ৭-৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করবে, সে ব্যক্তি বেহেশতে আমার সাথী হবে। হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাজীম ও সম্মান করলো, সে যেন ইসলামকেই জীবিত রাখলো। হযরত ওসমান (রাঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করলো, সে যেন বদর ও হোনাইনের যুদ্ধে শরীক হলো। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন- যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করবে এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার উদ্যোক্তা হবে, সে দুনিয়া থেকে (তওবার মাধ্যমে) ঈমানের সঙ্গে বিদায় হবে এবং বিনা
হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার উপকারিতা সম্পর্কে বুঝার জন্য উপরোক্ত হাদীসই যথেষ্ট। এর জন্য সামান্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলে অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমন- বেহেস্তে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর সাথী হওয়া, ইসলামকে জীবিত রাখা, বদর ও হোনাইনের মত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সমতুল্য নেকী অর্জন করা এবং পৃথিবী থেকে ঈমানের সঙ্গে বিদায়ের নিশ্চয়তা ও বিনা হিসাবে বেহেস্তে প্রবেশ করার মত সৌভাগ্য লাভ করা সম্ভব হবে ‘মিলাদুন্নবীর’ মাধ্যমে।
আল্লামা আবুল খায়ের শামসুদ্দীন ইবনে জাজরী (রহঃ) বলেছেন- রাসূলে মক্ববুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বেলাদাতের রাত্রে তাঁর আগমনের সুসংবাদ শুনে খুশী হওয়ার কারণে কাফেরের শাস্তি যদি হালকা হতে পারে, তাহলে একজন তাওহীদবাদী মুসলমান যদি রাসূলে (সা.) আগমণের তারিখে খুশী হয়ে সাধ্যমত সম্পদ ব্যয় করে, এর প্রতিদানে আল্লাহপাক তাঁকে বিশেষ অনুগ্রহে জান্নাতুন নাঈমে প্রবেশ করাতে পারেন।
উপরোক্ত কোরআন এবং হাদিস থেকে বুঝা যায় ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন হচ্ছে জান্নাত পাওয়ার মাধ্যম এবং
সাহাবায়ে কেরামের আমল। তাই ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে রাসূলে (সা.) এর আদর্শ থেকে বিচ্যুতি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে
সজাগ থাকা একান্ত প্রয়োজন এবং রাসূলের (সা.) স্মরণে বেশি বেশি দুরূদশরীফ পাঠ করা উচিত।
এএইচ/