ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কোথা হতে আসে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:০০ পিএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

ক্রিকেটার তুলে আনার ক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ডের অবদান নেই, যা করছে জেলা পর্যায়ের কোচরা করছেন, বিদেশী একটি গণমাধ্যমকে এ কথাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক কোচ পারভিন নাসিমা নাহার পুতুল। ক্রিকেট বোর্ড এই ক্রিকেটারদের আলাদাভাবে কোনো প্রশিক্ষণ দিয়ে দল বানাচ্ছে না বলেই মনে করেন পারভিন।

‘আমরা প্রত্যেকটা জেলার কোচদের সাথে বসতাম, আমরা ছেলে-মেয়েদের ক্রিকেট খেলা নিয়ে আলাপ করতাম। এখন তো সেটা করার প্রয়োজন হয়না। অনেক বাবা-মা নিজেরাই ছেলে-মেয়েদের ক্রিকেট খেলা শেখান।’ খবর বিবিসি’র।

ক্রিকেটাররা উপজেলা-জেলা হয়ে, স্থানীয় কোচদের সাথে কোচিং করে প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগে খেলার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে জানিয়েছেন পুতুল। পুতুলের ভাষ্যমতে, একাডেমি, বোর্ড বা কোনো প্রতিষ্ঠান না। স্থানীয় পর্যায়ের ক্রিকেটাররা নিজ আগ্রহে স্থানীয় কোচদের কাছেই ক্রিকেট শেখে।

মাঠের গল্প:
বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট স্কোয়াডে আনকোরা নতুন একজন ক্রিকেটার সুযোগ পেয়েছেন, তার নাম সাইফ হাসান।

তিনি এই টেস্ট সিরিজে সুযোগ পাওয়ার পরপরই আবাহনী ক্রিকেট ক্লাবের একাডেমিতে গিয়ে সতীর্থদের সাথে সেলিব্রেট করেন। এছাড়া সাদমান ইসলাম অনিক, নাজমুল হোসেন শান্তও বাংলাদেশের ক্রিকেট একাডেমির ছাত্র। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার সংস্কৃতি খুব বেশি সমৃদ্ধ বা পুরোনোও নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ওয়ানডে বা টেস্টে একটা ম্যাচ জয়ের জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করেছে।

এরপর বাংলাদেশের নির্বাচকরা তুলনামূলক দীর্ঘমেয়াদী একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। সেটা হলো তুলনামূলক তরুণ ক্রিকেটারদের তৈরি করা। 

আরিফুল ইসলাম রনি, একজন ক্রীড়া সাংবাদিক যিনি বিগত দশকে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলছেন, ‘টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরপর ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা ছিল খুব খারাপ, তখন নির্বাচকরা দুই ধাপে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির কাজ করছিলেন। এক ধাপে এসেছিলেন আশরাফুল, নাফীস ইকবালরা। পরের ধাপে ছিলেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা।’

সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তবে শুধু তরুণদের ওপর বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড খুব একটা সুফল পায়নি। আরিফুল ইসলাম রনি মনে করছেন, এই ব্যর্থতার পেছনে একটা বড় কারণ মানসিক বাধা। ‘ভালো প্রতিভাবান ক্রিকেটার পাওয়া কঠিন ছিল, স্কিলের সমস্যাও ছিল।’

লিটন দাস কিছুদিন আগেও ঘরোয়া ক্রিকেটে দুই শত রানের একটি ইনিংস খেলেন, কিন্তু জাতীয় দলে ঢোকার পরে তার ব্যাটে রান নেই। সম্প্রতি ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে তিন ম্যাচে লিটন দাস রান করেছেন ৪৫।

আরিফুল ইসলাম রনির মতে, ‘ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেও অনেকেই সুযোগ পান না এই কারণে। ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে তরুণ ক্রিকেটার নিয়ে আসা হয়। তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে খাপ খাওয়াতে অনেক সময় নিয়ে নেন।’

ঠিক এই সময়েই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বয়সভিত্তিক দলগুলো নিয়ে কাজ করা বাড়িয়ে দেয়। অনুর্ধ্ব-১৫, ১৭ ও ১৯ - তিনটি জাতীয় দল গঠন করে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড। এক্ষেত্রে অবশ্য আইসিসির নীতিমালা ও বাধ্যবাধকতাও ছিল। অনুর্ধ্ব-১৯ দল থেকে নিয়মিত ক্রিকেটার উঠে আসা শুরু করে ঠিক এই সময়টাতেই। বাংলাদেশের বয়স-ভিত্তিক দলগুলো থেকে ক্রিকেটার তুলে আনার দায়িত্ব ছিল নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাঁধে। যিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেমস ডেভেলপমেন্টের ন্যাশনাল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। তামিম ইকবাল তারই অধীনে অনুর্ধ্ব-১৫ দলে খেলেছেন।

কিন্তু তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান কিংবা মুশফিকুর রহিম যেভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে মানিয়ে নিয়েছেন বা নিজেদের আরো এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সেক্ষেত্রে বাকিরা অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছেন। 

সৌম্য সরকার, লিটন দাস, এনামুল হক বিজয় এর বড় উদাহরণ। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলেও ঠিক প্রত্যাশা মতো পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা।

আরিফুল ইসলাম রনির মতে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও জানে যে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট মানসম্মত নয়, এজন্যই তারা ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেললেও সরাসরি তাকে দলে নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবে। এইখানে তারা বয়সভিত্তিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল যেহেতু তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রাখে।’

পরবর্তীতে ঘরোয়া ক্রিকেটের ওপর জোর আরও বাড়ানো হয় ২০১৬-১৭ সেশনে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের ক্রিকেটের তিনটি স্তর ১৫, ১৭ ও ১৯ এর জন্য পরীক্ষা নেয়া হয়। সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ৩০,০০০ ক্রিকেটার। সেখান থেকে ৮২ জন ক্রিকেটারকে নির্বাচন করে বয়স অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া হয়।

নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন, এই ৩০ হাজার একটা সংখ্যা মাত্র, এদের মধ্যে ১০ শতাংশও যদি সিস্টেমে ঢুকে যায় সেটাও অনেক বড় ব্যাপার হবে বাংলাদেশের মতো দেশে।

সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রনি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট বদলে যাওয়ার ব্যাপারটার দিকেও চোখ বুলিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন ঘরোয়া ক্রিকেটে যারা ভালো করছে তারা 'এ'-দলে খেলছে। হাই পারফরম্যান্স টিম তৈরি হচ্ছে।’ বিগত তিন চার বছর ধরে 'এ'-দল ও এইচপি দল নিয়মিত মাঠে নামছে।

যেখানে ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদের মতো ক্রিকেটাররা বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন। রনি বলেন, ‘উপমহাদেশের এই সংস্কৃতি আছে যে কেউ বয়স-ভিত্তিক ক্রিকেটে ভালো করলে সেখান থেকে সরাসরি জাতীয় দলে নিয়ে আসা হয়। খুব অসাধারণ কিছু না করলে ভারত, শ্রীলঙ্কায় তেমন নেয়া হয় না। বাংলাদেশে এই পরিবর্তনটা একটু ধীরে হচ্ছে, কিন্তু একটু একটু করে হলেও হচ্ছে এটা।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কথা
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্টের একজন কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম। জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ঠিক কী উপায়ে ক্রিকেটারদের তুলে এনে জাতীয় দলে খেলায়?

তিনি প্রথমেই একাডেমি দলগুলোর প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় একটি টুর্নামেন্ট আয়োজিত হচ্ছে যার নাম একাডেমি কাপ। এই টুর্নামেন্ট থেকে সেরা ক্রিকেটারদের বাছাই করা হয়।’ ঢাকায় বর্তমানে ৮৯টি ক্রিকেট একাডেমি রয়েছে।

‘যত একাডেমি থাকবে আমাদের জন্য সেটা তত ভালো। আমরা সেখান থেকে (খেলোয়াড়) তুলে আনি। অনুর্ধ্ব-১৪ বলেন অনুর্ধ্ব-১৮ হোক একাডেমি থেকেই তারা এই পর্যায়ে আসেন।’

তবে তিনি দাবি করেন, ঢাকার চেয়ে রাজশাহীর একাডেমি থেকেই বেশি ক্রিকেটার আসেন। প্রক্রিয়ার কথাও বলেন তিনি, ‘আমরা স্কুল ক্রিকেট ও বয়স-ভিত্তিক দুটো গ্রুপ করি। সেখানে জেলা পর্যায়ে আমাদের ৬৪জন কোচ আছেন। তারা জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে কেন্দ্রে আসে। এরপর আমরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের পথে এগোই।’

এই ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ জন ক্রিকেটার বাছাই করা হয়। সম্প্রতি অনুর্ধ্ব-১৬ দল পাকিস্তানে সফরে গিয়েছে, এরপর অনুর্ধ্ব-১৫ দল ভারত সফরে যাবে। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান কতটা, এমন প্রশ্নে শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বন্ধু সংগঠন হিসেবে কাজ করে বিকেএসপি। বিকেএসপি থেকেই আমরা ক্রিকেটার পাই, আবার আমরা যে হান্টিং করি তারাই তো বিকেএসপিতে ভর্তি হয়, এটা আমাদের জন্যই ভালো হয়।’

বিকেএসপি থেকে আসা সেরা ক্রিকেটার:
* নাঈমুর রহমান দুর্জয়
* আল শাহরিয়ার রোকন
* সাজিত হাসান
* মোঃ রাহুল
* সাজ্জাদ হোসেন শিপন
* আব্দুর রাজ্জাক
* আনোয়ার হোসেন
* সাব্বির রহমান
* মুশফিকুর রহিম
* সাকিব আল হাসান
* নাঈম ইসলাম
* নাসির হোসেন
* কাজী শাহাদাৎ হোসেন
* সগির হোসেন পাভেল
* আনামুল হক বিজয়
* মমিনুল হক
* শামসুর রহমান
* সোহরাওয়ার্দী শুভ
* সৌম্য সরকার
* লিটন দাস
* তানভীর আহমেদ
* মোহাম্মদ মিঠুন
* আরিফুল হক
* জাকির হাসান 

এমএস/এসি