এক পাহাড়ের চুপকথা!
শায়লা শারমিন শুভ্রা
প্রকাশিত : ০৮:৫৮ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ১১:০৩ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০১৯ সোমবার
এক রথি এক রথি করে বেড়ে ওঠা মেয়েটা প্রজাপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। লাল, সাদা হলুদ কত রঙের প্রজাপতি। সময় পেলেই প্রজাপতির পেছনে ছুটে। সে কি সহজ কাজ? ঝক্কি-ঝামেলারর কাজ। তা বুঝে উঠতে চায় না স্নিগ্ধ। একটু বড় হয়েই সে পাহাড় হওয়ার স্বপ্ন বুনলো। অটল স্নিগ্ধ। টলবে না কোন কিছুতেই। সে পাহাড়ের সাথে সখ্যতা করে নিল।
অদ্ভুত রকমভাবে তার চোখে ভাসত এক দুর্ভেদ্য গুহার মুখ! কিশোরী স্নিগ্ধ ইহার মানে বুঝে উঠে না। ভাবতে নিলেই অস্থির হয়ে উঠে।
স্নিগ্ধ, মুগ্ধ দুই বোন। তাদের বাবা মস্ত অফিসার। মা কলেজের অধ্যাপিকা। স্নিগ্ধের জন্মের আগ অব্দি অধ্যাপনা করেছেন। তারপর রিজাইন লেটার দিয়ে ফুল টাইম গৃহিনী। সেই সাথে স্নিগ্ধ-মুগ্ধের প্রিয় বান্ধবী। বাবা জনাব হারুন-অর-রশিদও দুই মেয়ের ভালো বন্ধু।
স্নিগ্ধ-মুগ্ধ পাশাপাশি হওয়ায় স্নিগ্ধ গ্রামে দাদা-দাদীর কাছে বেড়ে উঠেছে কৈশর অব্দি। সেই হিসেবে বাবা-মায়ের জগৎ মুগ্ধই বেশি দখল করে নিয়েছে। তবুও স্নিগ্ধ সব জায়গায় স্নিগ্ধতা ছড়ায়। তার দখলদারিত্বটা ভিন্ন মায়ায় জড়ানো।
স্নিগ্ধের শৈশব কেটেছে সুমেশ্বরী নদীর বালুচরে। গারো পাহাড় দেখেই কি পাহাড় হওয়ার স্বপ্ন বুনলো? দুর্ভেদ্য গুহার মুখ চোখে ভাসে কেন স্নিগ্ধের? গুহার প্রবেশ দ্বার ভেদ করে ভেতরে যাওয়ার কথা ভাবতেই স্নিগ্ধ আঁতকে উঠে। ভাবে আমি পাহাড় হতে চাই। কোন শিকল আমাকে আটকাবে না। নদীর বালুচর, দিগন্তমাখা অস্তাচল, ভোরের সূর্যালোক, পাখির কুহুতান, নীল-নীলিমা -এসবে হারিয়ে যেত স্নিগ্ধ। বন-বাদড়, আল-বিল, পথ-ঘাট, বন্য ফুল-পাতা সবের সাথে তার একাত্মা। সে বিশাল অভিজ্ঞতার ঝুড়ি নিয়ে বড় হয়েছে।
১৪ বছর বয়সে সে ফিরে আসে বাবা-মা, মুগ্ধের কাছে। দাদা-দাদীর কাছে বেড়ে উঠা স্নিগ্ধ সহজ-সরল, সাদা-মাঠা। শৈশব কেটে যাওয়ার পর স্নিগ্ধ নিজ থেকে আসেনি দাদা-দাদীকে ছেড়ে। এখন সাথে নিয়ে তবেই এসেছে। দাদা-দাদী বিশাল বাড়ি, পতি-পত্তির মায়া রেখে নাতীর মায়ায় হার মানলো।
অন্যদিকে, মুগ্ধ বেড়ে উঠেছে শহুরে ধাঁচে। শহুরে অভিজ্ঞতার ঝুড়ি নিয়ে বেড়ে উঠা চালাক মুগ্ধ বড় বোনকে আগলে রাখে। বাবার চোখের মণি স্নিগ্ধ। তাতে আবার আপত্তি নেই মুগ্ধের।
অঘটনটা ঘটে গেল এক বিকাল বেলায়। স্নিগ্ধ অবাক হয়ে আকাশ দেখছে।
: আপু! তোমার নাম মুগ্ধ হওয়ার ছিল।
: মুগ্ধ দেখ দেখ.. আমি আকাশে রবী ঠাকুর আঁকাইছি।
: কই আপু? আমি দেখতে পাচ্ছি না।
: দেখ দেখ.. পাশে নজরুল বসে আছে।
মুগ্ধ অবাক হয়ে স্নিগ্ধকে দেখছে। এই আপু পাগল হয়ে গেছিস নাকি? সেই বিকাল থেকে স্নিগ্ধ চুপ হয়ে গেল। তার পৃথিবীটা একার হয়ে গেল। সে একা থাকতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে আর মনে মনে ভাবে সে কি পাহাড় হয়ে যাচ্ছে? অনতিক্রম পাহাড় আর দুর্ভেদ্য গুহার মুখোমুখি কখন হবে? একলা হাজারটা ভাবনা তার। ডাক্তার রায় দিলেন সিজোফ্রেনিয়া।
এভাবেই ঝড়-ঝাপটা মাথায় নিয়ে স্কুল পেরিয়ে কলেজ। কলেজ পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ইউনিভার্সিটি। মুগ্ধ তখন এইচএসসি দিবে। স্নিগ্ধ সাস্টে (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) ফরেস্ট নিয়ে ভর্তি হল। বন রাণী হওয়ার ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে দুঃসাহসিক ভাবে।
স্নিগ্ধের বন্ধুত্ব হল ম্যাথে পড়ুয়া কাব্যের সাথে। ছেলেটা তখন প্রেমের বিরহে ধুকছে। এক দুঃসাহসিক প্রতিজ্ঞা করল ছেলেটা। ৫০টা মেয়ের চোখের জল ঝরিয়ে তবেই সে কান্ত হবে।
সহজ-সরল স্নিগ্ধের সঙ্গে ছেলেটার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একেবারে আপনি থেকে তুই..!
: তোর ভেতর কি যেন আছে রে স্নিগ্ধ। তুই আমার আগা-মাথা বুঝে যাস।
: কি আছে রে কাব্য? (স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বলে)
: তা বলতে পারবো না। তুই অনেক বেশি ভালো।
ইতোমধ্যে কাব্য অনেক মেয়ের চোখের জল ঝরিয়েছে। স্নিগ্ধের তা ভালো লাগে না। এক আকাশ অধিকার জন্মেছে কাব্যের প্রতি। সব সময়ের সঙ্গী সে, কিন্তু রোমাঞ্চ করে যাচ্ছে অন্য মেয়েদের সাথে। অভিনয়ের রোমাঞ্চ!
স্নিগ্ধের একটু লাগে। পরক্ষণেই ভাবে পাহাড় হওয়ার স্বপ্নের কথা।
এক বছর পেরিয়েছে। মুগ্ধ বোনের পথ ধরে সেও সাস্টে ম্যাথ পেয়ে গেছে। শহুরে ধাঁচে বড় হওয়া মুগ্ধ বোনকে বল- “আপু! তোর কলিজার বন্ধু মেয়েদের সাথে টাইম স্পেন্ড করে মাত্র। ছেলেটা খুব একটা ভালো না।”
স্নিগ্ধ চুপ থাকে। দুই বছর পেরোনোর সময় বুঝতে পারে স্নিগ্ধের দুর্ভেদ্য গুহাটা হচ্ছে কাব্য! তিন বছর পেরোনোর আগেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের পাহাড়টাকে ভেঙে দিল দুর্ভেদ্য গুহাটা। স্নিগ্ধ মেয়েটা বাস্তববাদী নয়, কাল্পনিক। তবে শুদ্ধতায় বিশ্বাসী। ছেলেখেলার ভালোবাসায় বিশ্বাসী না।
ভিন্ন ধর্মের দুই জন। তবুও আবেগ, ভালোবাসার কাছে বিবেক হার মানল। কাব্য তুই থেকে তুমিতে টেনে নিল। অবুঝ স্নিগ্ধ তখনো জানল না কাব্যের একজন প্রেয়সী আছে। মুগ্ধ বিষয়টা স্নিগ্ধকে জানায়। স্নিগ্ধের ভালোবাসার গভীরতা এতই যে -এই বিষয়টা সিরিয়াসলি নেয়নি। মুগ্ধ মাকে সব জানালো। তারপর মা বাবাকে। বাবা কিছুতেই মেনে নিবেন না। এই দিকে স্নিগ্ধ আকাশে কাব্যের সাথে পিচ্চি এক মেয়েকেও আঁকতে শিখে গেল! সিজোফ্রেনিক স্নিগ্ধ পাগলের মতো আচরণ করে। নির্লজ্জের মতো কাব্য আর পিচ্চি মেয়ের কথা বলে। বাবা সব মেনে নিলেন। যুদ্ধ জয়ী স্নিগ্ধ কাব্যের কাছে হেরে গেল।
কাব্য বলত- “বাবাকে বল, কাব্য তোমার আর্দশ হবে।” যে কাব্য একদিন স্নিগ্ধকে হারানোর ভয়ে আঁতকে উঠতো, সেই কাব্য হঠাৎ পাল্টাতে শুরু করল। স্নিগ্ধ জানতে পারল কুমু নামে এক মেয়ে, কাব্যের সাথে নয় মাসের রিলেশনশিপ দাবি করে। স্নিগ্ধের হাতে পরিয়ে দেওয়া উপহার কুমুর জন্য কেনা।
এদিকে, সিজোফ্রেনিক স্নিগ্ধ আস্তে আস্তে মানসিক অবনতির দিকে ধাবিত হতে লাগলো। স্নিগ্ধ ভাবল, এই সেই গুহার মুখ! অটল পাহাড়কে ধ্বসে দিল। সে কি আর সোজা হতে পারবে?
কাব্য জানিয়ে দিল- সে সব কিছুর জন্য দুঃখিত। তার ধর্ম, মা-বাবা সবার আগে। একটা স্নিগ্ধ মরে গেলে কিছু আসে যায় না তার। স্নিগ্ধ আত্মসম্মানটুকু বিকিয়ে দিয়ে কাব্যকে বলল তার সাথে থাকতে। ফলাফল শূন্য। ছায়ার মতো মানসিক শক্তি জুগাচ্ছে মুগ্ধ।
চতুর্থ বছর। যে কাব্যের জন্য বাবার সাথে, পরিবারের সাথে যুদ্ধ হল। সেই কাব্য এখন শত আলোকবর্ষ দূরে। বাবা আর পরিবার এখন স্নিদ্ধের সব। সিজোফ্রেনিয়া রেহাই দিল স্নিগ্ধকে। স্নিগ্ধ সিদ্ধান্ত নিল ধ্বসে যাওয়া পাহাড়কে শক্ত করে গড়বে। কোন গুহাই টলাতে পারবে না।
ফরেস্ট স্নাতকোত্তর শেষ করে বাবার ইচ্ছে আমেরিকার ডাকাটো ইউনিভার্সিটিতে চলে গেল স্নিগ্ধ। সে পড়া আর বন রাণী হয়ে কাটিয়ে দিবে বাকি পথ। বহুদিন পেরিয়ে বহুমাস শেষে কোন এক বছর স্নিগ্ধের ফোন বেজে উঠলো- গিভ থ্যাংকস টু আল্লাহ....। আর ও পাশে কাব্যের এক যুগের পরিচিত কন্ঠস্বর। স্নিগ্ধের মনে পড়লো একটা বাক্য! একদিন বড্ড অভিমানে স্নিগ্ধ বলেছিল, “আমি তোর কে?” কাব্য বলেছিল- “তুই আমার সুখ, শাষণ, খুশী, আবদারের স্থান।”
ওপাশ থেকে প্রথম বাক্যই- “আর কাউকে ভালোবাস নাই স্নিগ্ধ?”
খানিক চুপ থেকে স্নিগ্ধ জবাব দিতে শুরু করলো, “তোমাদের শহরে, সত্য-মিথ্যা লেপটে থাকে। পৃথক করতে গিয়ে ক্লান্ত হতে চাই না। মিথ্যা অভিনয়ে ভরপুর ভালোবাসা খুঁজার সময় কই? এই বরং ভালো প্রাণ খোলে ভালোবাসতে শিখি। মনকে করি খোলা মাঠের হাওয়ার মত। শুদ্ধ-শূচি-শুভ্র।”
ওপাশ থেকে- “স্নিগ্ধ! সত্যিই তুমি পাহাড় হয়েছ।”
লেখক: শায়লা শারমিন শুভ্রা, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ।