ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

ইসলামের প্রথম সামরিক যুদ্ধ ‘বদর’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:৫৩ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার

দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান। মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয় মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী। যা মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ। ‘বদর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক এ লড়াই ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের। এটি ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম।

এ যুদ্ধ মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। এতে জয়ের ফলে মুসলিমদের ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।

এ যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধ হয়। বদর ছিল দুই বাহিনীর মধ্যে প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। যুদ্ধে সুসংগঠিত মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। এ যুদ্ধে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ আবু জাহল নিহত হন। মুসলিমদের বিজয়ের অন্যদের কাছে বার্তা পৌছায় যে মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এর ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ (সা.) এর অবস্থান দৃঢ় হয়।

ইসলাম প্রচার শুরু করার পর মুহাম্মাদ (সা.) মক্কার কুরাইশদের পক্ষ থেকে বিরোধীতার সম্মুখীন হন। মুসলিমদের উপর নির্যাতনের কারণে মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করে। মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও এক পর্যায়ে মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের পরে অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতে মুসলিমদেরকে অস্ত্রধারণের অনুমতি দেয়া হয়। মদিনায় আসার পর মুহাম্মাদ (সা.) তিনটি প্রধান সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

প্রথমত, মদিনার গোত্রগুলোর সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্থাপন করা।

দ্বিতীয়ত, কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের তথ্য সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করা।

তৃতীয়ত, মদিনার পাশ দিয়ে সিরিয়াগামী মক্কার বাণিজ্য কাফেলায় অভিযান চালানো।

এরপর সিরিয়ার পথে যাতায়াত করা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাগুলোর উপর বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।

৬২৩ সালের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে মুহাম্মাদ (সা.) সিরিয়া অভিমুখী মক্কার একটি বড় বাণিজ্যিক কাফেলার বিরুদ্ধে অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এই কাফেলায় কুরাইশদের অনেক মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ছিল। মুসলিম বাহিনীর সদস্য ছিল ১৫০ থেকে ২০০ জন এবং আরোহণের উট ছিল ৩০টি। মুহাম্মাদ (সা.) তাদের নিয়ে যুল উশাইরাহ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিমরা পৌছানোর কয়েকদিন পূর্বে কুরাইশরা সে পথ অতিক্রম করে চলে যাওয়ার কারণে মুসলিমরা তাদের পথরোধ করতে পারেনি। এই অভিযানটি গাজওয়ায়ে উশাইরা নামে পরিচিত। ইবনে ইসহাকের মতে এই অভিযানের জন্য মুহাম্মাদ (সা) ২ হিজরির জামাদিউল আওয়াল মাসের শেষে বের হয়ে জামাদিউল আখির মাসের শুরুতে ফিরে এসেছিলেন।

৬২৪ সালের জানুয়ারিতে (২ হিজরির রজম মাস) মুহাম্মাদ (সা.) বারো জন মুহাজিরকে অভিযানে পাঠান। বাহিনীর প্রতি দুইজনের আরোহণের জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। মুহাম্মাদ (সা.) বাহিনীর নেতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহশকে একটি চিঠি দিয়ে বলেন যাতে দুই দিনের পথ অতিক্রম করার পর এই চিঠি পড়া হয়। নির্দেশ মোতাবেক দুইদিনের পথ অতিক্রম করার পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ চিঠিটি পড়েন। এতে নির্দেশ দেয়া হয় যে চিঠি পড়ার পর যাতে তারা অগ্রসর হয়ে মক্কা ও তাইফের মধ্যবর্তী নাখলায় পৌছায়। এরপর কুরাইশ কাফেলার আগমনের অপেক্ষা করে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে মদিনায় অবহিত করা হয়। চিঠির নির্দেশ পড়ার পর তারা অগ্রসর হন। তবে পথিমধ্যে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ানের উট হারিয়ে যায় ফলে তারা পিছিয়ে পড়েন।

আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ তার বাহিনীকে নিয়ে নাখলা পৌছে একটি কুরাইশ কাফেলা দেখতে পান। এতে আবদুল্লাহ ইবনে মুগিরার দুই ছেলে উসমান ইবনে আবদুল্লাহ ও নওফাল ইবনে আবদুল্লাহ এবং মুগিরার মুক্তপ্রাপ্ত দাস আমর ইবনে হাদরামি ও হাকিম ইবনে কাইসান ছিলেন। এই দিনটি ছিল রজব মাসের শেষ দিন। রজব যুদ্ধনিষিদ্ধ মাস ছিল তাই আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে মাস শেষ হওয়ার সময় দিলে কাফেলাটি মক্কার হারাম সীমানায় প্রবেশ করবে ফলে তাদের উপর আর আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বাহিনীটি কাফেলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। আক্রমণের শুরুতে তীরের আঘাতে আমর ইবনে হাদরামি নিহত হন। মুসলিমরা উসমান ইবনে আবদুল্লাহ এবং হাকিম ইবনে কাইসানকে গ্রেপ্তার করে। নওফাল ইবনে আবদুল্লাহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

রজব মাসে আক্রমণ করার কারণে মুসলিম দলটি ফিরে আসার পর মুহাম্মাদ (সা.) ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তিনি তাদের হারাম মাসে যুদ্ধের অনুমতি দেননি। তিনি কাফেলা থেকে অর্জিত সম্পদ এবং বন্দীদের গ্রহণে অসম্মতি জানান। অন্যদিকে রজব মাসে আক্রমণের কারণে কুরাইশরাও মুসলিমদের কটুক্তি করতে শুরু করে। এরপর কুরআনের অবতীর্ণ আয়াতে বলা হয় যে পবিত্র মাস লঙ্ঘন করার চেয়ে মক্কার লোকেদের অত্যাচার আরো বেশি নিকৃষ্ট। এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মুহাম্মাদ (সা) কাফেলা ও বন্দীদেরকে গ্রহণ করেন। উসমান ও হাকিমের মুক্তি চেয়ে কুরাইশরা বার্তা পাঠায় এবং বিনিময় হিসেবে পণ্য প্রদানের কথা বলে। কিন্তু ইতিপূর্বে নিখোজ হওয়া সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও উতবা ইবনে গাজওয়ান তখনও ফিরে আসেননি। কুরাইশদের হাতে তাদের জীবনের আশঙ্কা থাকায় তিনি সেসময় প্রস্তাবে রাজি হননি। এরপর তারা দুইজন ফিরে আসেন এবং পণ্য গ্রহণ করে বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়। বন্দীদের মধ্যে হাকিম ইবনে কাইসান ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় থেকে যান। পরবর্তীতে বিরে মাউনায় তিনি নিহত হয়েছিলেন। উসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কা চলে যান।

ইতিপূর্বে গাজওয়ায়ে উশাইরা থেকে বেঁচে যাওয়া কুরাইশ কাফেলাটি সিরিয়া থেকে মক্কা ফেরার সময় মুহাম্মাদ (সা.) তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য তালহা ইবনে উবাইদিল্লাহ ও সাইদ ইবনে জাইদকে উত্তরে প্রেরণ করেন। তারা হাওরা নামক স্থানে পৌছে কুরাইশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকেন এবং কাফেলা এই স্থান অতিক্রমের সময় তারা মদিনায় ফিরে ঘটনা অবহিত করেন। কাফেলাটিতে একহাজার উট এবং এসব উটে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা মূল্যের মালামাল ছিল। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাফেলায় রক্ষী ছিল ৪০জন।

এই কাফেলায় আক্রমণের জন্য মুহাম্মাদ (সা.) মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানান। তবে পরবর্তীতে বৃহদাকার কুরাইশ বাহিনীর সম্মুখীন হতে হবে এমন আশঙ্কা তখনও ছিল না তাই তিনি এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি বলে উল্লেখ করেননি। ফলে অনেক মুসলিম মদিনায় থেকে যায়। ঘোষণার পর মুহাম্মদ (সা) বদরের দিকে যাত্রা করেন।

মুহাম্মাদ (সা.) এর সঙ্গে মুসলিম বাহিনীতে ছিলেন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মুসআব ইবনে উমাইর, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আবু যার আল-গিফারী। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে উসমান ইবনে আফফান যুদ্ধে যেতে পারেননি। সালমান ফারসি এসময় অন্যের দাস ছিলেন তাই তিনিও যুদ্ধে অংশ নেননি। বাহিনীতে সৈনিক সংখ্যা ছিল ৩১৩জন। এর মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ছিলেন ৬১জন ও খাজরাজ গোত্রের ছিলেন ১৭০জন। মুসলিমদের সাথে ৭০টি উট ও দুইটি ঘোড়া ছিল। ফলে তাদের সামনে পায়ে হেটে যাওয়া বা প্রতি দুই বা তিনজনের জন্য একটি উট ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। একটি উটে পালাক্রমে দুই বা তিনজন আরোহণ করতেন। এই ব্যবস্থায় মুহাম্মাদ (সা), আলি ইবনে আবি তালিব ও মারসাদ ইবনে আবি মারসাদের জন্য একটি উট বরাদ্দ হয়েছিল।

মুহাম্মাদ (সা.) সার্বিক নেতৃত্বের জন্য মুসআব ইবনে উমাইরকে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন। মুহাজিরদের ও আনসারদের জন্য একটি করে কালো পতাকা যথাক্রমে আলি ইবনে আবি তালিব এবং সাদ ইবনে মুয়াজকে প্রদান করা হয়। বাহিনীর ডান ও বাম অংশের প্রধান হিসেবে যথাক্রমে যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও মিকদাদ ইবনে আমরকে নিযুক্ত করা হয়। মুসলিম বাহিনীতে থাকা দুইটি ঘোড়ায় তারা আরোহণ করেছিলেন। পেছনের অংশের প্রধান হিসেবে কাইস ইবনে আবিকে নিয়োগ দেয়া হয়। মুহাম্মাদ (সা) সমগ্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

আক্রমণের আশঙ্কায় কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান যাত্রাপথে সাক্ষাত লাভ করা বিভিন্ন কাফেলাগুলোর কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলেন। ফলে তিনি মুসলিমদের আক্রমণের খবর পান। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠানো হয়। সে দ্রুত মক্কা পৌছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী উটের নাক চাপড়ায়, আসন উল্টিয়ে দেয়, নিজের জামা ছিড়ে ফেলে এবং উটে বসে ঘোষণা করে যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে পারে।

মক্কায় পৌছানোর পর জমজম ইবনে আমর গিফারির আহ্বান করে বলেন, ‘কুরাইশগণ, কাফেলা আক্রান্ত, কাফেলা আক্রান্ত। আবু সুফিয়ানের সঙ্গে তোমাদের সম্পদ রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীরা এগিয়ে আসছে। তাই আমার মনে হয় না যে তোমরা তা পাবে। তাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো।’

এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন শুরু হয়। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম‌ ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত।

আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়। আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়। উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

অন্যদিকে আবু সুফিয়ান ক্রমাগত খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন। বদরের নিকটে পৌছার পর মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। তাকে তিনি মদিনার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাজদি স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। তবে জানান যে দুইজন উষ্ট্রারোহীকে তিনি টিলার পাশে উট বসিয়ে মশকে পানি পূর্ণ করতে দেখেছেন। তাই আবু সুফিয়ান সতর্কতা হিসেবে সেখানে যান এবং উটের গোবর ভেঙে দেখেন। গোবর থেকে প্রাপ্ত খেজুরের বিচি দেখে বুঝতে পারেন এগুলি মদিনার খেজুর ফলে মুসলিমদের আগমনের ব্যাপারে তিনি সন্দেহমুক্ত হন। এরপর তিনি কাফেলাকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলের দিকে ইয়ানবুতে চলে যান। মক্কার বাহিনী জুহফা নামক স্থানে পৌছার পর আবু সুফিয়ানের প্রেরিত বার্তা বাহক এসে জানায় যে কাফেলা নিরাপদ আছে তাই আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

এই খবর পাওয়ার পর মক্কার বাহিনীর অধিকাংশ ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু বাহিনীর প্রধান আবু জাহল যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে অসম্মতি দেখান। এরপর বনু জুহরা গোত্রের মিত্র ও গোত্রটির সেনাপ্রধান আখনাস ইবনে শারিক ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ তার পক্ষে সায় না দেয়ায় তিনি বনু জুহরা গোত্রের ৩০০ সদস্য নিয়ে মক্কা ফিরে আসেন। এর ফলে মক্কার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,০০০। পরবর্তীতে বনু জুহরা গোত্রের সদস্যরা আখনাসের এই সিদ্ধান্তের কারণে আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

একইভাবে বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আবু জাহলের জেদের কারণে তারা যুদ্ধে অংশ নেয়। মক্কার বাহিনী অগ্রসর হয়ে বদর উপত্যকার একটি টিলার পেছনে আশ্রয় নেয়।

‘আর স্মরণ করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তে আসবে। অথচ তোমরা চাইছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তে আসুক, আর আল্লাহ চাইছিলেন সত্যকে তার বাণী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে।’

(কুরআন : সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭)

মুসলিমরা মক্কার বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পায়। মুসলিম বাহিনীটি মূলত কাফেলা আক্রমণের জন্য গঠিত হয়েছিল, ব্যাপক যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। মুসলিমরা এসময় কুরাইশদের মুখোমুখি না হয়ে ফিরে যেতে পারত কিন্তু এর ফলে কুরাইশদের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেত এবং তারা অগ্রসর হয়ে মদিনা আক্রমণ করতে পারত।

অন্যদিকে বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মদিনার আনসাররা আকাবার বাইয়াত অনুযায়ী মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য ছিল না এবং অভিযানের ব্যয়ভার তাদের উপর বেশি ছিল। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য মুহাম্মাদ (সা.) যুদ্ধসভার আহ্বান করেন। সভায় মুহাজির, আনসার সকলেই কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে মত দেয়। এরপর মুসলিমরা অগ্রসর হয়ে বদরের নিকটে পৌছায়।

এখানে পৌছার পর মুহাম্মাদ (সা.) ও আবু বকর প্রতিপক্ষের খবর সংগ্রহের জন্য বের হন। এসময় এক বৃদ্ধ লোককে তারা দেখতে পান। মুহাম্মাদ (সা.) তাকে মুসলিম ও কুরাইশ উভয় বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। ঐ ব্যক্তি দুই বাহিনী সম্পর্কেই সঠিক তথ্য দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আলি ইবনে আবি তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হয়। তারা বদরের কূয়ায় দুইজন পানি সংগ্রহরত ব্যক্তিকে বন্দী করেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা জানায় যে তারা মক্কার বাহিনীর সদস্য এবং বাহিনীর জন্য পানি সংগ্রহ করছিল। মুহাম্মাদ (সা.) এসময় নামাজরত ছিলেন। উপস্থিত মুসলিমরা তার কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তাই তারা তাদের মারধর করে পুনরায় একই প্রশ্ন করে। এরপর তারা জবাব দেয় যে তারা কুরাইশ বাহিনীর নয় বরং আবু সুফিয়ানের কাফেলার লোক।

একথা জানতে পেরে মুহাম্মাদ (সা) ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তারা সত্যই বলছিল অথচ এরপরও তাদের মারধর করা হয়েছে। এরপর তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা উপত্যকার শেষ প্রান্তের টিলা দেখিয়ে বলে যে কুরাইশরা তার পেছনে অবস্থান করছে এবং প্রতিদিন নয় বা দশটি উট তাদের জন্য জবাই করা হয়। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ (সা) বলেন যে তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১,০০০ হবে। এরপর বন্দীরা বাহিনীতে আগত সম্ভ্রান্ত কুরাইশ নেতাদের নাম বলে।

মক্কার নেতাদের নাম শোনার পর মুহাম্মাদ (সা.) মন্তব্য করেন, ‘মক্কা তার কলিজার টুকরোগুলিকে তোমাদের পাশে এনে নিক্ষেপ করেছে।’

এরপর মুহাম্মাদ (সা.) দ্রুত বদরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন। তার লক্ষ্য ছিল যাতে কুরাইশরা কূয়ার দখল নিতে না পারে। রাতে মুসলিমরা বদরের নিকট থামে। এসময় হুবাব ইবনে মুনজির বলেন যে এটি যদি আল্লাহর নির্দেশ হয় তবে তা যেন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু যদি মুহাম্মাদ (সা.) কৌশল হিসেবে এখানে থেমে থাকেন তবে তার মত হল যাতে এখানে অবস্থান না করে কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে অবস্থান নিয়ে বাকি সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নিজেদের কূয়ার উপর চৌবাচ্চা তৈরী করে তাতে পানি জমা করা হয়। এর ফলে মুসলিমরা পানি পেলেও কুরাইশরা পানি থেকে বঞ্চিত হবে। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ (সা.) পরামর্শ মেনে নিয়ে নির্দেশ দেন যাতে রাত অর্ধেক পার হওয়ার পূর্বেই কুরাইশদের সবচেয়ে নিকটের কূয়ার কাছে গিয়ে শিবির স্থাপন করা হয়। এরপর সেখানে পৌছে চৌবাচ্চা তৈরী করে অবশিষ্ট সব কূপ বন্ধ করে দেয়া হয়।

মুসলিমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী কূয়া দখল করার পর সাদ ইবনে মুয়াজের পরামর্শক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তরপূর্বের টিলার উপর মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্য একটি তাবু নির্মিত হয়। এখান থেকে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেত।

যুদ্ধের দিন যুদ্ধ শুরুর সময় মুহাম্মাদ (সা.) মুনাজাত করে বলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ তা পূর্ণ করো। হে আল্লাহ, আমি তোমার ওয়াদার পূর্ণতা কামনা করছি।’

যুদ্ধের দিন কুরাইশরা শিবির ভেঙে বদরের দিকে রওয়ানা হয়। বদরে পৌছে তারা উমাইর ইবনে ওয়াহাবকে মুসলিমদের খবর সংগ্রহের জন্য পাঠায়। উমাইর এসে জানান যে মুসলিমদের বাহিনী ছোট এবং সাহায্যের জন্য নতুন সেনাদল আসার সম্ভাবনাও নেই। তবে তিনি একইসাথে বলেন তারা সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে আছে এবং তারা কুরাইশদের বিশেষ লোকদেরকে হত্যা করে ফেলতে পারে। এভাবে তিনি কুরাইশদের পক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করেন। আরব যুদ্ধে হতাহতের পরিমাণ বেশি হত না তাই একথা শোনার ফলে কুরাইশদের মনোবল হ্রাস পায়। তারা পুনরায় তর্কে জড়িয়ে পড়ে।

কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকিম ইবনে হিজাম আরেক নেতা উতবা ইবনে রাবিয়াকে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়। জবাবে উতবা বলেন যে তিনি ফিরে যেতে রাজি আছেন এবং নাখলায় নিহত আমর ইবনে হাদরামির রক্তপণ পরিশোধ করতেও তিনি রাজি। কিন্তু আবু জাহল রাজি নয় বলে তিনি হাকিমকে বলেন যাতে তাকে রাজি করানো হয়। এরপর উতবা উপস্থিত কুরাইশদের উদ্দেশ্য বলেন যে এই যুদ্ধে তাদের হাতে হয়ত নিজেদের ভাইয়েরাই নিহত হবে তাই যুদ্ধে বিজয়ী হলেও নিহতদের লাশ দেখতে তারা পছন্দ করবে না এবং তারা আত্মীয় হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত হবে। তাই তার পরামর্শ ছিল যাতে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায় এবং মুহাম্মাদ (সা.)কে অন্য আরব গোত্রসমূহের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। যদি তারা তাকে হত্যা করে তবে কুরাইশদের উদ্দেশ্যও সফল হবে এবং এর ফলে মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে তারা নির্দোষ থাকবে।

হাকিম ইবনে হিজাম এসময় আবু জাহলের কাছে গিয়ে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু জাহল কঠোরভাবে বলেন যে যুদ্ধ না করে তিনি ফিরে যাবেন না। সেই সঙ্গে উতবার ফিরে যাওয়ার পরামর্শকে ধিক্কার দিয়ে অভিযোগ করেন যে উতবার ছেলে মুসলিমদের দলে রয়েছে বলে উতবা ছেলেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

উল্লেখ্য, উতবার ছেলে আবু হুজাইফা ইবনে উতবা ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক যুগে মুসলিম হয়েছিলেন। হাকিমের কাছে এ কথা জানতে পেরে উতবা বিব্রত হন এবং বলেন যে তিনি কাপুরুষ নন এবং মুহাম্মাদ (সা) এর সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত ফিরে যাবেন না ঘোষণা করেন। অন্যদিকে আবু জাহল নাখলায় নিহত আমরের ভাই আমির ইবনে হাদরামির কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন যে উতবা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যেতে চায় তাই তার ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নেয়া সম্ভব হবে না। একথা শোনার পর আমির সারা শরীরে ধূলো মেখে কাপড় ছিড়তে ছিড়তে নিহত ভাইয়ের জন্য মাতম করতে থাকে। এসবের ফলে যুদ্ধ বন্ধের জন্য হাকিমের সব তৎপরতা ব্যর্থ হয়।

যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কুরাইশদের আসওয়াদ ইবনে আবদুল আসাদ মাখজুমি এগিয়ে এসে মুসলিমদের পানির জলাধার দখল করে নেবে। আর তা যদি তিনি না পারেন প্রয়োজনে এজন্য জীবন দেবেন বলে ঘোষণা দেয়। এরপর হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব অগ্রসর হয়ে তার সঙ্গে লড়াই করেন। লড়াইয়ে আসওয়াদের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আহত অবস্থা আসওয়াদ চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে যায় এবং প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য চৌবাচ্চার সীমানার ভেতর ঢুকে পড়ে। এরপর হামজা তাকে হত্যা করেন। এটি ছিল বদরের প্রথম মৃত্যু।

এরপর তৎকালীন রীতি অনুযায়ী দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে লড়াই শুরু হয়। কুরাইশদের মধ্য থেকে উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া ও ওয়ালিদ ইবনে উতবা লড়াইয়ের জন্য অগ্রসর হন। তাদের লড়াইয়ের আহ্বান শুনে আনসারদের মধ্য থেকে আওফ ইবনে হারিস, মুয়াব্বিজ ইবনে হারিস ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এগিয়ে আসেন। কিন্তু কুরাইশ যোদ্ধারা তাদেরকে কটাক্ষ করে বলেন যে তারা তাদের যোগ্য না এবং যেন কুরাইশদের সমশ্রেণীর কাউকে লড়াইয়ের জন্য পাঠানো হয়। এরপর তাদের বদলে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, উবাইদা ইবনে হারিস ও আলি ইবনে আবি তালিবকে পাঠানো হয়। হামজার সাথে শাইবা, আলির সঙ্গে ওয়ালিদ ও উবাইদার সঙ্গে উতবা লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। কুরাইশ পক্ষের তিনজনই লড়াইয়ে নিহত হয়। লড়াইয়ে উবাইদা আহত হন তাই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। যুদ্ধের কয়েকদিন পর তার মৃত্যু হয়। তিনজন নেতৃস্থানীয় যোদ্ধার মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের মনোবলে ফাটল ধরে।

দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর কুরাইশরা মুসলিমদের উপর আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধের পূর্বে মুহাম্মাদ (সা.) নির্দেশ দেন শত্রুরা বেশি সংখ্যায় কাছে এলেই যাতে তীর চালানো হয়। মুসলিমরা ‘ইয়া মানসুর আমিত’ স্লোগান দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে মক্কার কুরাইশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুয়াজ ইবনে আমর ও মুয়াজ ইবনে আফরা কুরাইশ পক্ষের সর্বাধিনায়ক আবু জাহলকে হত্যা করেন। বিলালের হাতে তার সাবেক মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ নিহত হয়। উমর ইবনুল খাত্তাব তার মামা আস ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে হত্যা করেন। বিকেলের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়।

কুরআনে উল্লেখ রয়েছে যে এই যুদ্ধে হাজারো ফেরেশতা মুসলিমদের সহায়তার জন্য এসেছিল।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নিহত মুসলিমদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে দাফন করা হয়। নিহত কুরাইশদের লাশ ময়দানের একটি কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়। এসময় চব্বিশজন প্রধান কুরাইশ নেতার লাশ কূয়ায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আরবের রীতি অনুযায়ী মুসলিমরা তিনদিন যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করার পর মদিনায় ফিরে আসে।

যুদ্ধের পর মুসলিমরা মদিনায় ফিরে আসে। এতে কয়েকজন কুরাইশ নেতাসহ ৭০জন বন্দী হয়। বন্দীদের সঙ্গে সদ্বব্যবহার করা হয়েছিল। মুসলিমরা নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খেতে দেয়।

বন্দীদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে মুহাম্মাদ (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

সভায় আবু বকর মত দেন যে বন্দীদের সবাই মুসলিমদেরই ভাই, একই বংশের সদস্য অথবা আত্মীয়। তাই তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া উচিত যাতে মুসলিমদের তহবিলে অর্থ সঞ্চিত হয় এবং বন্দীরা ভবিষ্যতে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ পায়।

উমর ইবনুল খাত্তাবের মত ছিল বন্দীদের প্রতি কোনো প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শন না করে মুসলিমদের প্রত্যেকে বন্দীদের মধ্যে নিজ নিজ আত্মীয়কে হত্যা করে যাতে এটা প্রমাণ হয় যে মুশরিকদের ব্যাপারে মুসলিমদের মনে কোনো দুর্বলতা নেই।

মুহাম্মাদ (সা) আবু বকরের মত মেনে নিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়। পাশাপাশি মুত্তালিব ইবনে হানতাব, সাইফি ইবনে আবি রিফায়া ও আবু ইজজা জুমাহিসহ কয়েকজন বন্দীকে মুক্তিপণ ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। শেষোক্ত দুইজন পরবর্তী উহুদের যুদ্ধে নিহত হয়। এছাড়া যারা পড়ালেখা জানত তারা ১০জন নিরক্ষর মুসলিমদেরকে শিক্ষা দিলে তা মুক্তিপণ হিসেবে গৃহীত হবে ঘোষণা করা হয়। বন্দীদের মধ্যে মুহাম্মাদ (সা.) এর মেয়ে জয়নব বিনতে মুহাম্মাদের স্বামী আবুল আসও ছিল। জয়নবকে মদিনা আসতে বাঁধা দেবে না এই শর্তে আবুল আসকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। বন্দীদের মধ্যে মক্কার সুবক্তা সুহাইল ইবনে আমরও ছিলেন। উমর সুহাইলের সামনের দুইটি দাঁত ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে তিনি আর মুসলিমদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা নিতে না পারেন। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা) এই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সুহাইল মক্কার পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন। আরও পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

দুইজন যুদ্ধবন্দীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। এরা হলেন নাদার ইবনে হারিস ও উকবা ইবনে আবু মুয়াইত। বদর থেকে ফেরার সময় সাফরা উপত্যকায় নাদার ইবনুল হারিস এবং ইরকুজ জুবয়া নামক স্থানে উকবা ইবনে আবু মুয়াইতকে হত্যা করা হয়।

কুরাইশদের পরাজয়ের খবর হাইসমান ইবনে আবদুল্লাহ মক্কায় নিয়ে আসে। নিহতদের শোকে মক্কায় মাতম শুরু হয়। কিন্তু এরপর তারা সংযত হয় যাতে তাদের মাতমে মুসলিমরা আনন্দিত না হয়। তাছাড়া মুক্তিপণ নিয়ে তাড়াহুড়া না করতে বলা হয়। কুরাইশরা বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরের বছর দুই বাহিনী উহুদের যুদ্ধে পুনরায় মুখোমুখি হয়।

বদরের যুদ্ধ সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধ জয়ের ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ (সা.) এর কর্তৃত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অন্য আরব গোত্রগুলো মুসলিমদেরকে নতুন শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করে। মদিনার অনেকে এসময় ইসলাম গ্রহণ করে। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিমদেরকে খুবই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়।

অন্যদিকে যুদ্ধে আবু জাহলসহ মক্কার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে আবু সুফিয়ান নতুন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তীতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তিনি কুরাইশদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিম হওয়ার পর আবু সুফিয়ান মুসলিম সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তীতে তার ছেলে মুয়াবিয়া উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন।

বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় ছিল- সব কিছুর জন্য সবার উপরে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশি হওয়া বিজয়ের মাপকাঠি নয়। বরং মহান আল্লাহর ওপর দৃঢ় ঈমান ও নির্ভরতা হলো বিজয়ের মূল হাতিয়ার।

সূত্র : ইসলামী পুস্তক ও ইউকিপিডিয়া
এসএ/