কৌতুহলাক্রান্ত ও উঁকি প্রবণ জাতির নিম্নমুখিতা
ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন
প্রকাশিত : ১১:২১ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৯ বুধবার
বাঙ্গালীরা স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি কিউরিয়াস মাইন্ডের। এদিক সেদিক উঁকি দিতে খুব পছন্দ করেন। তাই আমি বলি, আমরা স্বভাবজাতভাবেই ‘কৌতুহলাক্রান্ত ও উঁকি প্রবণ জাতি’। অন্যের প্রত্যেক বিষয়ে আমাদের প্রবল উৎসাহ ও আগ্রহের পরিমাণটা সবসময় বেশি। একটা সময় গ্রামাঞ্চলে যাদের বেড়ার ঘর ছিল সেখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটত। দুই ঘরের পার্টিশনের যে বেড়াটা ছিল, সেখানে থাকত একটা গোপন ছিদ্র। দেখা গেল; ঘরের মধ্যে গেরস্থ একান্ত মুহুর্তে আছে, মনে হল কেউ যেন তাকিয়ে আছে। আপনি বুঝে উঠতেই আচমকা সরে গেল এক জোড়া চেনা চোখ। যখন তখন পাশের ঘরে চোখ রাখতেই এই বিশেষ ব্যবস্থা। দুই দিক থেকেই নজর রাখার এই বিশেষ ব্যবস্থা। অথবা দুই বাড়ির সীমানা দেয়ালেও বিশেষ কায়দায় নজর রাখার কোন না কোন ব্যবস্থা থাকবে। পাশের বাড়ির লোকজন কি করছে তা দেখার প্রবল আগ্রহ থেকে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে। অন্যের হাঁড়ির খবর জানার জন্য আমরা সদা ব্যস্ত। কিছু একটা পেয়ে গেলেই ‘ইউরেকা’। এই জাতির কিউরিসিটির পরিমান এত বেশি যে, রাস্তার পাশে কেউ একটা গর্ত খুড়লেও দেখা যাবে, সেখানে ডজনখানেক লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর এটা সেটা মন্তব্য করছে।
কেউ কিছু একটা বিষয় দেখলে বা জানলেই হয়। পেটের ভেতরে যেন হজম হতেই চায় না। যতক্ষন না পর্যন্ত অন্যকে জানানো যায়, ততক্ষন শান্তি নেই। এক তীব্র মানসিক যন্ত্রনা। পাশের বাড়ির ভাবিকে জরুরী তলব অথবা কলতলায় আড্ডায়... ‘শুনেছেন ভাবি... খবরদার কাউকে বলবেন না যেন। অমুকের...’ ব্যাস একে অন্যের কানে কানে সারা দুনিয়া। জাতি উন্নত হয়েছে, উন্নত হয়েছে আমাদের পারিপার্শিক অবস্থানের। বেড়ার বা টিনের ঘর কমে গেছে, পাকা দালান উঠেছে। লাইফস্ট্যাইল ডিজিটাল হয়েছে। কিন্তু পুরনো অভ্যেস কিছুতেই ছাড়তে পারছে না জাতি। অন্যের বেডরুমে উঁকি দেয়ার অভ্যাস। বহুকালের জিনগত অভ্যাস কি সহজে ছাড়া যায়? অন্যের একান্ত মুহুর্তের সর্বশেষ খবরাখবর রাখতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল চোখ। প্রযুক্তির এই অসাধারণ ব্যবহার কেবল এই জাতিই করতে জানে বলে মনে হয়। কানা-কানির যুগের অবসান ঘটে ইদানিং শুরু হয়েছে ইনবক্স চালাচালি, শেয়ার আর ফরোয়ার্ড যুগ।
নাম সামাজিক মাধ্যম হলেও সেটা আজকাল বড্ড অসামাজিক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কলতলার গসিপিং আরো একধাপ এগিয়ে ডিজিটালাইজড হয়েছে। নিজের খবর বাদে, অন্যের হাড়ির খবর থেকে শুরু করে বেডরুম, গোসল খানার সব খবর আমাদের গুরুত্বপুর্ন স্ট্যটাসের বিষয়বস্তু। অন্যের ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে আমাদের প্রবল জানার আগ্রহ। কে কাকে ছেড়ে দিয়েছে, কে কাকে ডিভোর্স দিয়েছে। কার বউ কার সাথে ভেগে গেল। কে কার সাথে পরকীয়া করছে। বেশি বয়সে কে সন্তানের জনক হল। বেশি বয়সে কারা বিয়ে করেছে, কার কত বয়স ছিল। আরো আগে কেন করেনি, এতদিন পরে কেন করল? ইত্যাদি ইত্যাদি অন্যের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমাদের কি জ্ঞান গর্ব আলোচনা। যেমন ধরুন- “সে এই কাজটা মোটেও ভাল করেনি। তাঁর মেয়ের বয়েসি ছিল।” “নাহ এইটা মেনে নেয়া যায় না। তার চাইতে বরের কালার ব্ল্যাক” অথবা “বরের চাইতে কনের বয়স অত্যাধিক বেশি।” কে কাকে বিয়ে করবে না করবে সেই উপদেশও দিতে দ্বিধা করছেনা অনেকে... “সে চাইলে আরো ভাল জামাই পেত, টাকার জন্যে এই লোককে বিয়ে করেছে।” এমনকি বিভিন্ন নামি দামী ওয়েব পোর্টালে বড় বড় আর্টিক্যাল লিখে ফেলছে ‘কে, কাকে, কেন বিয়ে করেছে’ এমন গুরুত্বপুর্ন বিষয় নিয়ে। টেলিভিশন চ্যানেল গুলো টক-শো, লাইভ অনুষ্টান বানাচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা কেবল বিয়ে শাদী কিংবা একে অন্যের সম্পর্কের বিষয়ে। আর এতে বিশেষজ্ঞগন চমৎকার সব মতামত দিচ্ছেন। এই দেশে এখন বিয়ে করাটাও বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। কোন অসামঞ্জস্য পেলেই সেটা হবে জাতীয় ইস্যু। সেলুকাস!
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেটা দূরের কোন আত্মীয় স্বজন, পুরনো কোন স্কুল বন্ধুর সাথে দীর্ঘদিন পর যোগাযোগ। হারিয়ে যাওয়া মানুষেরও খোঁজ পাওয়া যায় এই সামাজিক মাধ্যমে। বহুকালের প্রিয় মানুষের একখানা ছবি দেখে মানুষ যে পরিমান আনন্দিত হয়েছিল এই মাধ্যমে, এখন সেটা বিষিয়ে উঠেছে অনেকটা। এই মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারে অসুস্থতার পর্যায়ে চলে গেছে। বেডরুম আর ড্রইং রুমের পার্থক্য ভুলিয়ে দিয়েছে। মানুষ পারছে না কেবল; অন্যের শোবার ঘরে একটা সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়ে বসে বসে টেলিভিশনে দেখতে। এইটা করতে পারলেই হয়ত মনে শান্তি পেত। আমাদের এই অভ্যাসের কারনে কত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে, সে হিসেব আমরা কি রাখি? উদাহারন স্বরূপ যদি বলি; একজন নারী বা পুরুষ যার সামাজিক পরিচিতি আছে মোটামুটি পাবলিক ফিগার বলা চলে, তাঁর জীবনের এমন এক পর্যায়ে এসে চরম একাকীত্বে ভোগছে, যার একজন পাশে থাকা মানুষ চাই কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা কেবল লোকলজ্জার কারনে, মানুষ কি বলবে এই কারনে। সে জানে এই বয়সে জীবনসঙ্গী বানানো মানেই সংবাদ পত্রে ছয় কলামের লেখা। বড় বড় ফেসবুক সেলিব্রেটিদের বিশেষজ্ঞ মতামত। কারো অভিনন্দন বার্তা আবার কারো নেতিবাচক শব্দের প্রয়োগ। এসব নিয়ে মানুষ এখন ভীত।
অন্যের বিষয়ে, অপরের ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে আমাদের যে পরিমান আগ্রহ উন্মাদনা সেটা পৃথিবীর অন্য কোন জাতির আছে বলে মনে হয় না। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো যেন আমাদের প্রত্যহ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সেখানে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে অযাচিত কৌতূহল প্রকাশ করতে দ্বিধা করছিনা। অনেকে অজ্ঞতা বশত হুট করে জনসম্মুখে অবান্তর কোন প্রশ্ন করে ফেলছে। আর কেউ কেউ এটা করেন নিছক বিব্রত করতে। এই যেমন; অনেক দিন হল বিয়ে করেছেন কিন্তু বাচ্চা নিচ্ছেন না কেন? বয়েস কত হল, বিয়ে করেন না কেন? মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন না কেন? এমনকি আপনি এতো মোটা কেন, চিকন কেন, বেটে কেন? এটা কেন, সেটা কেন ইত্যাদি হরেক রকমের কৌতূহল। এইসব অবান্তর প্রশ্ন করে আপনি যেমন তাঁর কাছে চিরশত্রুতে পরিনিত হচ্ছেন তেমনি তাঁর জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলছেন। নিজের ব্যাপারে আমরা যত সিরিয়াস নই, অন্যের বিষয়ে ততবেশি সিরিয়াস। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টেনে এনে যত্রতত্র আলোচনার মাধ্যমে মানুষকে মব জাস্টিসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এখন চাইলেই আপনি যে কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে সামাজিক মাধমে লিখতে পারেন, খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন। এই অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? এই ব্যাপারে কোন নিয়ম নীতি নেই। এতে যে অন্যের প্রাইভেসি লঙ্ঘন হচ্ছে সে খেয়াল কেউ রাখছি না। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন আইন বা নীতি নেই। এই অতি কিউরিসিটি এ জাতিকে ডুবাতে বেশি সময় হয়ত নিবে না। আমাদের এত কিউরিসিটি থাকা উচিৎ নয়। এতে আমাদের নিজেদের যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে, তেমনি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এইসব উচ্ছিষ্ট পরিহার করে বরং আমরা লেখক সাহিত্যিক বিমল মিত্রের এই কথাটায় মনোনিবেশ করতে পারি। তিনি বলেছেন- “সাধারণের চরিত্রগুণে রাজ্য হয়; সাধারণের চরিত্রদোষে রাজ্য যায়। রাজারা উপলক্ষ মাত্র। সিরাজ-উ-দ্দৌলার দোষে রাজ্য যায় নাই। সে সময়ে সর্বগুণ সম্পন্ন অন্য কেহ নবাব থাকিলেও সাধারণের চরিত্রদোষে রাজ্য যাইত।” আমাদের কারনেই আমাদের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমরাই ধ্বংসের মূল। আমরা কেবল আমাদের নিজেদের জীবন সুন্দর রাখা ও চারিদিকের পরিবেশ সুন্দর রাখায় ভুমিকা রাখি। এতেই জাতির জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক; কলামিস্ট, সংগঠক।
আরকে//