ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ভারতে এনকাউন্টার নিয়ে বিতর্ক

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৩৫ পিএম, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

ভারতের হায়দ্রাবাদ শহরে এক তরুণী পশু চিকিৎসককে গণধর্ষণ করে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় আটক চার অভিযুক্ত পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।

শুক্রবার ভোরে এ ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেন তেলেঙ্গানা পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জিতেন্দ্র। খবর বিবিসি’র।

কয়েকদিন জেল হাজতে থাকার পরে গত বুধবার ঐ চারজনকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরে শুক্রবার অভিযুক্তদের ধর্ষণ ও হত্যার স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযুক্তরা এক পুলিশ কর্মকর্তার পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের গুলি করা হয়। 

গত বৃহস্পতিবার ২৭ বছর বয়সী ঐ নারী চিকিৎসকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার তদন্তে পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার অভিযোগে দেশটিতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অভিযুক্তদের হত্যার পাওয়ার পর ভুক্তভোগীর মা বলেছেন, ‘ন্যায়বিচার হয়েছে।’এ ঘটনায় মানুষ আতশবাজি ফুটিয়ে উদযাপন করছে এবং কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পুলিশের প্রশংসা করছে।

শুক্রবার কী হয়েছে?
সাইবারাবাদের পুলিশ কমিশনার ভিসি সাজনার বলেছেন, পুলিশ তদন্তের অংশ হিসেবে ঘটনা পুননির্মানের জন্য অভিযুক্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। তারা পুলিশ সদস্যদের বন্দুক ছিনিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি করে। এতে অন্তত দুই পুলিশ কর্মকর্তা আহত হন। 

হায়দ্রাবাদে ঐ পশু চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুলিশকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষত যখন ভুক্তভোগীর পরিবার পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ভূমিকার অভিযোগ আনে। ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পরে কয়েক হাজার মানুষ হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে হায়দ্রাবাদ থানার সামনে বিক্ষোভ করেন।

দেশের অন্যান্য স্থানেও বিক্ষোভ ও মিছিল বের করা হয়। ভারতীয় আইনে ধর্ষণের শিকার নারীদের নাম প্রকাশ করা হয় না। 

ভুক্তভোগীর পরিবার কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
ভুক্তভোগীর পরিবারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অভিযুক্তরা নিহত হওয়ার পর প্রতিবেশীরা এ ঘটনায় পটকা ফাটিয়ে এবং মিষ্টি বিতরণ করে উদযাপন করছেন। 

‘আমি এ অনুভূতি ভাষায় বোঝাতে পারবো না। আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে আবার দুঃখও লাগছে কারণ আমার মেয়ে তো আর ঘরে ফিরবে না।’ এমনটি বলছিলেন ভুক্তভোগীর মা। 

তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ের আত্মা এখন শান্তিতে আছে। ন্যায়বিচার হয়েছে। আমি কখনই ভাবিনি যে আমরা ন্যায়বিচার পাব। আমার মেয়ের সাথে যা হয়েছে তা যেন অন্য কোনও মেয়ের সাথে না হয়।’

ভারতে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের আইনটিকে আরও ‘কঠোর’ করার দাবি জানান তিনি। ভুক্তভোগী চিকিৎসকের বোন বলেন, ‘পুরুষরা যেন নারীদের দিকে তাকাতেও ভয় পায়, কারণ তাদের শাস্তি পেতে হবে।’ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি আদালতের বিচারের প্রত্যাশা করছিলাম। এই ঘটনা আমার বোনকে ফিরিয়ে দেবে না, তবে এটি অনেক স্বস্তির। পুলিশের এমন পদক্ষেপের কারণে এখন থেকে কেউ আবার এই জাতীয় কিছু করার আগে দুই বার চিন্তা করবে।’

ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
পুলিশের এমন পদক্ষেপের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে।  অনেকে টুইটার এবং ফেইসবুকে পুলিশের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, ‘তারা ন্যায়বিচার করেছেন।’

২০১২ সালে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি বাসে গণধর্ষণে নিহত হওয়া মেডিকেল শিক্ষার্থীর মাও অভিযুক্তদের হত্যার বিষয়টিকে প্রশংসা করেছেন। তিনি এএনআই সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, ‘এই শাস্তির খবর পেয়ে আমি অত্যন্ত খুশি। পুলিশ অনেক ভাল কাজ করেছে।’ হত্যার ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয় সাংবাদিকরা বলেছেন, সেখানে প্রায় দুই হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে, যার ফলে বিশাল যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।

যানবাহনগুলি মহাসড়কে স্থবির হয়ে আছে। সেখান থেকে মানুষ পুলিশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এর আগে সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর গোলাপের পাপড়ি ছিটায় এবং মিষ্টি বিতরণ করেন। প্রাক্তন বলিউড তারকা ও ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষের সদস্য জয়া বচ্চন সপ্তাহের শুরুতে বলেছিলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘পিটিয়ে হত্যা’ করা উচিত। তিনি পার্লামেন্টে বক্তৃতায় বলেন, ‘আমি জানি এটি শুনতে কঠোর মনে হচ্ছে, তবে এই ধরণের মানুষদের জনসমক্ষে প্রকাশ‍্যে পিটিয়ে হত্যা করা উচিত।’

কংগ্রেস, বিজেপিসহ নানা দলের নেতা-নেত্রী এবং অন্যান্য রাজনীতিবিদরাও এ নির্মম গণধর্ষণ ও হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন এবং পুলিশের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছেন। ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় সাইনা নেহওয়াল টুইট করে হায়দ্রাবাদ পুলিশকে ‘সালাম’ জানিয়েছেন।

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
পুলিশের এ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বেশ কয়েকজন। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এবং পুলিশের সংস্কারের মূল স্থপতি প্রকাশ সিং বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে এড়ানো যেতো। তিনি বলেন, ‘হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের যখন আদালতে বা অপরাধের জায়গায় নেওয়া হয়, তখন প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। তাদেরকে বের করার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। হাতকড়া পরাতে হবে এবং সঠিকভাবে তল্লাশি চালাতে হবে। কারণ পুলিশ যদি সতর্ক না হয় তাহলে যেকোন সময় যেকোন ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে’।

ঘটনাটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিনা সেটা এতো তাড়াতাড়ি বলা যাবে না বলেও উল্লেখ করেন প্রকাশ সিং। তিনি বলেন, ‘ভারতে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড ‘এনকাউন্টার কিলিং’ নামে পরিচিত।’

অন্যদিকে বিজেপি নেত্রী মানেকা গান্ধী এভাবে পুলিশ এনকাউন্টারে অভিযুক্তদের মেরে ফেলার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এ বন্দুক যুদ্ধের বিরোধিতা করি। এটা একটা ভয়াবহ ঘটনা। আইন কেউই নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। বিচার হলে নিঃসন্দেহে এদের ফাঁসির সাজা হত। বিচারের আগেই যদি গুলি করে অভিযুক্তকে মেরে দেওয়া হয়, তাহলে আদালত, পুলিশ বা বিচার ব্যবস্থার দরকার কি?’

প্রশ্ন তুলেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। তার কথায়, ‘মানুষ এ এনকাউন্টারের কারণে উৎসব পালন করছেন, কিন্তু এটা আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে একটা গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিল। গোটা দেশের ভাবা দরকার যে ফৌজদারি বিচার বিভাগ আর তদন্ত বিভাগকে কি করে শক্তিশালী করা যায়।’

ভারতের সংসদেও এ নিয়ে বিতর্ক চলছে এখন
মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন, পুলিশই যদি বিচার করে ফেলে তাহলে আর আইন আদালতের প্রয়োজনটা কী! পুলিশ বলছে, নিহতদের দেহের ময়না তদন্ত যেমন করা হচ্ছে তেমনই গোটা বন্দুক যুদ্ধের তদন্তও করা হবে।

কীভাবে পশুচিকিৎসকের হত্যার ঘটনা উদঘাটন হয়েছিল?
১০ দিন আগে ভুক্তভোগী ঐ নারী একজন চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টে যাওয়ার জন্য স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে তার মোটরসাইকেলে করে বাড়ি থেকে বের হন। পরে পরিবারকে ফোন দিয়ে তিনি জানান যে, তার মোটরসাইকেলের টায়ারের হাওয়া বেরিয়ে গেছে। এবং একজন ট্রাক চালক তাকে সাহায্য করার কথা জানিয়েছেন।

তিনি জানান, তিনি একটি টোল প্লাজার কাছে অপেক্ষা করছিলেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়। বৃহস্পতিবার সকালে ফ্লাইওভারের নিচে ঐ নারীর মরদেহ খুঁজে পান এক দুধ বিক্রেতা।

গত সপ্তাহে তিন নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, তারা নিখোঁজের খবর পুলিশকে দেয়ার পরও তারা কোন তাৎক্ষণিক কোন পদক্ষেপ নেননি। দেশটির সরকারী সংস্থা জাতীয় মহিলা কমিশনকে স্বজনরা জানান যে, ঐ কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তিনি (চিকিৎসক) পালিয়ে যেতে পারেন বলে পরিবারকে বলেছেন। 

নারীরা কি ভারতে নিরাপদ?
২০১২ সালের ডিসেম্বরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি বাসে এক মেডিকেল শিক্ষার্থীকে গণধর্ষণ ও হত্যার পর থেকে দেশটিতে নারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার বিষয়টি কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তবে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ কমার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ সালে ভারতে ধর্ষণের ৩৩ হাজার ৬৫৮টি মামলা পুলিশ রেজিস্ট্রি করেছে, এর অর্থ ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৯২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

এমএস/এসি