সুনামগঞ্জে রাজাকার পুত্রের হাত থেকে সরকারি সম্পদ দখলমুক্ত
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ০১:০৩ পিএম, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ বুধবার
একাত্তরের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের ‘মুক্তির মঞ্চ’সহ কয়েক কোটি টাকার সরকারি সম্পদ রাজাকার আব্দুর রউফের পুত্র শামীম আহমেদ গংদের কবল হতে অবশেষে দখলমুক্ত করা হল।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বিকাল ৫টার দিকে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের নির্দেশক্রমে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। উচ্ছেদ অভিযানে তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন ‘মুক্তির মঞ্চ’ ও কথিত কিন্ডার গার্ডেনের নামে দখলে থাকা সরকারি সম্পদ, তিনটি ভবন উদ্ধার করা হয়।
একই সঙ্গে টিনের বেষ্টনি গুঁড়িয়ে দিয়ে দখলে থাকা তিনটি ভবন সিলগালা করে দেয়ার পর লোহার বেষ্টনি দ্বারা বন্ধ করে দেয়া জনচলাচলের রাস্তাটিও পাঁচ বছর পর ফের উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দখল বাণিজ্যের অভিযোগ আনেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের তরং গ্রামের প্রয়াত আব্দুর রউফ তালুকদারের ছেলে শামীম আহমদ তালুকদার, তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সুর্য্যরে গাঁও’র প্রয়াত ললিত কুমার দাসের ছেলে রাষ্ট্রীয় সম্পাদ লুপাটকারি স্বপন কুমার দাস গংসহ বেশ ক’জন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে।
মুক্তিযোদ্ধারা লিখিক অভিযোগে জানান, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বড়ছড়া মৌজার ১নং খতিয়ানভুক্ত এসএ ও আরএস দাগে ৭৬.৩৬ একর সরকারি জমিতে ওই মৌজায় ওই দাগে খতিয়ানের থাকা প্রায় এক একর জমিজুড়ে মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত ’৭১-এর মুক্তির মঞ্চ, সমাবেশ স্থল, ছোট মাঠ, তিনটি ভবন, ভবনের ভেতর থাকা জিনিসপত্র সরকারি সম্পদ দখলে নেন পাকসেনাদের দোসর স্বাধীনতা বিরোধী আব্দুর রউফের ছেলে শামীম আহমদ ও স্বপন কুমার দাসের নেতৃত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুপাটকারি একদল ভূমিখেকো দানবচক্র।
২০১৫ সালে রাতের আঁধারে ‘মুক্তির মঞ্চ’ সরকারি জমি, ভবন দকলে নিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন নাম সর্বস্ব একটি কিন্ডারগার্টেনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন শামীম-স্বপন গংরা।
পরে জনসমাগম ও প্রশাসনের দৃষ্টি আড়াল করতে জনচলাচলের একমাত্র কাঁচা রাস্তাটিও বন্ধ করে দেয়া হয়।
শুধু সরকারি কোটির টাকার জমি দখলই নয়, ওই জমির ওপর থাকা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ট্যাকেরঘাট চুনপাথর খনিজ প্রকল্পের প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূল্যের শ্রমিক কর্মচারী ক্লাব, শ্রমিক ইউনিয়ন ভবন, শ্রমিক কর্মচারী ক্যান্টিনসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আসবাবপত্রসহ দখলে নেন শামীম-স্বপন গংরা।
এদিকে, ৪ ডিসেম্বর তাহিরপুর ‘মুক্ত দিবস’ পালন উপলক্ষে বিজয়র্যালি শেষে এক সমাবেশে পাকসেনাবাহিনীর দোসর স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার পুত্র ও তার সহযোগীদের দখল হতে বিজয় দিবসের প্রারম্ভে ‘মুক্তির মঞ্চ’ ও সরকারি সম্পদ উদ্ধার করা না হলে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ বিজয় দিবসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেন।
এ নিয়ে গত ৪ ও ৫ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টি নজরে আনেন সরকারের উপরমহল ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক।
পরবর্তীকালে গত ৮ ডিসেম্বর রোববার জেলা আইনশৃংখলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে ট্যাকেরঘাট সাব সেক্টরে ‘মুক্তির মঞ্চ’সহ সরকারি জমি, ভবন উদ্ধারে তাহিরপুরের ইউএনও, সহকারি কমিশনারকে (ভুমি) মঙ্গলবারের মধ্যে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা পেয়ে মঙ্গলবার বিকাল ৫টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজেন ব্যানার্জী ও সহকারি কমিশনার (ভুমি) মো. মুনতাসির হাসান থানা, ট্যাকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির সদস্য ও আনসার সদস্যদের নিয়ে ওই সরকারি জমি জুড়ে দখলে থাকা কথিত কিন্ডার গার্ডেন’র টিনশেড বেষ্টনি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে ৭১’র ‘মুক্তির মঞ্চ’ সমাবেশস্থল পাঁচ বছর পর বিজয়ের মাসে ফের উন্মুক্ত করে দেন।
এর পরপরই বীর মুক্তিযোদ্ধারা, বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন, সংস্কৃতিকর্মী, সাবেক শিক্ষার্থীরা ৭১’র ‘মুক্তির মঞ্চে’ অবস্থান নিয়ে বিজয় দিবসকে সামনে রেখে উল্লাস প্রকাশ ও সমাবেশ করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারের দায়িত্বশীল মহল, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, উপজেলা প্রশাসনের প্রতি ৭১’র ‘মুক্তির মঞ্চ’ স্থলে এক সমাবেশে স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের রাজাকার পুত্র গংদের দখল হতে অবরুদ্ধ ‘মুক্তির মঞ্চ’ সরকারি জমি, ভবন পুনরায় উদ্ধার করায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বীরমুক্তিযোদ্ধারা তাদের বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, এ ট্যাকেরঘাট সাব সেক্টরে থেকেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রয়াত সাংসদ আব্দুজ জহুর, প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, হোসেন বখত, সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর মুসলিম উদ্দিনসহ অসংখ্য বীরযোদ্ধা জাতির জনকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাতৃভূমি শুত্রুমুক্ত করতে ও স্বাধীনতা অর্জনে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। সেইসঙ্গে দেশ মাতৃকার টানে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ সিরাজ বীর উওম, শহীদ আবুল কালামের মতো অসংখ্য নাম না জানা বীরসন্তান পাকসেনাদের হাতে শহীদ হয়েছেন তাদের সমাধীস্থল রয়েছে এ ট্যাকেরঘাটে।
স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকার পরিবারের লোকজন যেন ৭১’র মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসহ, ইতিহাস, ঐতিহ্য মুছে না ফেলতে পারে সেজন্য এ ট্যাকেরঘাটের সাব সেক্টর ও ৭১’র ‘মুক্তির মঞ্চ’কে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা, গবেষষা ও ঐতিহ্য রক্ষায় দৃশ্যমান কিছু স্থাপনা তৈরি করবেন আশা রেখে জেলা প্রশাসক এবং সরকার প্রধান জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবেশে সেই দাবিও তুলে ধরেন।
উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে থানা মুক্তিযোদ্ধা সংদের সাবেক কমান্ডার, শহীদ সিরাজ স্মৃতি সংসদ সভাপতি হাজি রৌজ আলী, উপজেলার শ্রীপুর উওর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির উদ্দিন, ইউনিয়ন কমান্ডার আলকাছ উদ্দিন, বড়দল উওর ইউনিয়ন কমান্ডার নুর মাহমুদ, বড়দল দক্ষিণ ইউনিয়ন কমান্ডার আব্দুল কুদ্দুছ, ডেপুটি কমান্ডার গোলাম রব্বানী, ডেপুটি কমান্ডার আবু তাহের, বীরমুক্তিযোদ্ধা শাহানুর মিয়া, কুদরত আলী, সুজাফর আলী,সেলিম উদ্দিন, জাহের মিয়া, আবদুল মতিন, আব্দুল খালেক, খুর্শীদ আলী, আক্কল আলী, ট্যাকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই আবু মুসা, জেলা ও উপজেলায় কর্মরত প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ার কর্মরত সাংবাদিকগণ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, আওয়ামী লীগ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষাথী, সংস্কৃতিকর্র্মীসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধিক লোকজন, থানা পুলিশ এবং আনসার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
একে//