জাম্বিয়ার অভিযোগে মিয়ানমারের গণহত্যার রায়ের অপেক্ষা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:০০ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ শনিবার
জাতিসংঘের সবোচ্চ আদালতে (আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার শুনানি শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া এ শুনানি গত বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত এ আদালতে শেষ হয়েছে। এখন শুধু রায়ের পালা। তবে যে রায় আসুক না কেন মিয়ানমার এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি গণহত্যায় অভিযুক্ত দেশ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
এ আদালতের সিদ্ধান্ত মানার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে এবং এর বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন রায় কার্যকর করার এখতিয়ার এ আদালতের নেই। এমন এখতিয়ার না থাকলেও আন্তর্জাতিকভাবে নিষেধাজ্ঞার জন্য সুপারিশ করতে পারবে আদালত। আন্তর্জাতিক এ আদালতে ১৫ বিচারকের সঙ্গে প্যানেলে আছেন গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত দুই বিচারক। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।
এদিকে মিয়ামনমারের পক্ষে সাফাই করা দেশটির প্রতিনিধি শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচি আদালতে বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক বিচার কাঠামোকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। অভিযোগকারী দেশ গাম্বিয়ার প্রধান কৌঁসুলি পল রিখলার আদালতে মন্তব্য করেছেন, রাখাইনে নৃশংসতার জন্য দায়ী সেনা সদস্যদের বিচার ও সহিংসতা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উপর আস্থা রাখা যায় না।
শুনানি শেষ ও যুক্তিতর্কের দিন (বৃহস্পতিবার) দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনেন আইসিজের ১৭ সদস্যের বিচারকের প্যানেল। মামলার শুনানি শেষে রায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন তারিখ ঘোষণা না করে আন্তর্জাতিক এ আদালতের বিচারক প্যানেলের প্রধান আবদুলকাভি আহমেদ ইউসুফ বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব এ মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন তারা। তবে রায়ের আগ পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে কোন একটি পদক্ষেপের দাবি করেছিলেন বাদি গাম্বিয়ার কৌঁসুলি।
জানা যায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করার অভিযোগে মিয়ানমারকে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ আদালতে এনেছে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। মঙ্গলবার দ্য হেগের পিস প্যালেসে গাম্বিয়ার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করতে এসে দেশটির আইনমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান। পর দিন বুধবার মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিতে এসে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে গাম্বিয়া যে চিত্র এ আদালতে উপস্থাপন করেছে তা ‘অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’।
এদিকে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিপ্রায়ে সংঘটিত নৃশংস অপরাধে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে দায়ের করা জবাবদিহিতার প্রচেষ্টার সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নেদারল্যান্ডসের হেগে পিস প্যালেসে গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আদালতকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার ফিরিয়ে দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য মিয়ানমারের অভিযুক্ত দোষীদের দায়মুক্তির চলমান সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওআইসির ৫ সদস্যের পক্ষে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানিতে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিলো। প্রতিনিধি দলের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান যোগ দেন।
প্রতিনিধি দলটি রোহিঙ্গা সঙ্কট, নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং মর্যাদায় জোর করে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছে। প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জবাবদিহিতা এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির মধ্যে গুরুত্ব দেয়া হবে। আদালতের উপস্থিতির পাশাপাশি পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক আইসিসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি একদল আইএনজিও আয়োজিত ‘রাইট টু রিপ্লাই’ অনুষ্ঠানেও অংশ নেন। অনুষ্ঠানে তিনি কক্সবাজারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ইভেন্টে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কক্সবাজারের শিবিরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের মন্তব্যও জানানো হয়।
রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে কি না, সেই বিচারের এখতিয়ারই জাতিসংঘের এ আদালতের নেই বলে
আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে যুক্তি খণ্ডনে দাঁড়িয়ে এমন মন্তব্য করেছেন সু চি। সেনা সদস্য বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ থাকলে মিয়ানমার তা তদন্তের পর দায়ীদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা করে থাকে বলে দাবি করেছেন তিনি।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১৯৮৪ সালে স্বাক্ষরিত কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগে গণহত্যা প্রতিরোধ ও এর শাস্তি বিধানে আন্তর্জাতিক এ আদালতে মামলা করেছে গাম্বিয়া। ১৯৫৬ সালে ঐ ‘জেনোসাইড কনভেনশনে’স্বাক্ষর করেছিল মিয়ানমার। গাম্বিয়াও এ কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই কনভেনশনের আওতায় দেশগুলো শুধু গণহত্যা থেকে বিরত থাকাই নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা এবং এমন অপরাধের জন্য শাস্তি বিধানেও বাধ্য।
এমএস/এসি