মঙ্গল গ্রহে রহস্যময় ‘অক্সিজেন’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৫১ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ শনিবার
এখনও কি তা হলে প্রাণ টিঁকে আছে এই সৌরমণ্ডলে আমাদের নাগালে থাকা গ্রহ মঙ্গলে? ‘লাল গ্রহ’ মরে যায়নি পুরোপুরি? মঙ্গল-মুলুকে কি এখনও প্রাণকে টিঁকিয়ে রাখার জ্বালানি জুগিয়ে চলেছে অক্সিজেন?
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে এই প্রথম হদিশ মিলল অক্সিজেন অণুর। পৃথিবীর শ্বাসের বাতাস। প্রাণের বেঁচে থাকার প্রধান জ্বালানি। খবর আনন্দবাজার পত্রিকা’র।
এই আবিষ্কার ভিন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করে তুলল। যে আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে গেল এক অনাবাসী ভারতীয়ের নামও। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুশীল আত্রেয়।
নাসার রোভার ‘কিউরিওসিটি’র পাঠানো তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে লেখা সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ: প্ল্যানেটস’র সাম্প্রতিক সংখ্যায়।
বসন্তে লাফিয়ে বাড়ছে অক্সিজেন, দ্রুত কমছে শীত, গ্রীষ্মে!
গবেষকরা জানিয়েছেন, মঙ্গলের খুব পাতলা হয়ে আসা বায়ুমণ্ডলে অন্যান্য গ্যাসের সঙ্গে এখনও রয়েছে অক্সিজেন। অক্সিজেন অণু। যা দু’টি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গড়া। পৃথিবীর মতোই। আর তার পরিমাণটাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ০.১৩ শতাংশ।
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) থেকে পিএইচডি করার পর এখন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক, সহযোগী গবেষক সুশীল আত্রেয় ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যা আমাদের অবাক করে দিয়েছে, তা হল; মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে সেই অক্সিজেনের পরিমাণটা বিভিন্ন ঋতুতে বাড়া-কমা করছে। যেটা পৃথিবীতে হয় না। আমরা দেখেছি, মঙ্গলে যখন বসন্ত আসে, তখন তার বায়ুমণ্ডলে এক লাফে প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায় অক্সিজেনের পরিমাণ। তারপর বছর যত বাড়ার সঙ্গে তা ধীরে ধীরে কমে যেতে শুরু করে। এটা কেন হয়, এখনও আমরা তা বুঝে উঠতে পারিনি।’
পৃথিবীতে বসন্ত মানেই সবুজের সমারোহ। গাছপালার বাড়বাড়ন্ত। গাছে গাছে কচি পাতা, কচি কচি শাখা-প্রশাখার ভিড়। শীতে পাতা শুকিয়ে যায়। বসন্তে নতুন পাতায় ভরে যায় গাছগাছালি। এও জানি, গাছেদের বেঁচেবর্তে থাকার জন্য সূর্যের আলো নিয়ে রান্নাবান্না (সালোকসংশ্লেষ) করার সময় গাছপালা আমাদের বায়ুমণ্ডল থেকে ‘বিষ’ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে টেনে নেয়। আর বাতাসে ছেড়ে দেয় আমাদের শ্বাসের বাতাস অক্সিজেন। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের মূল জোগানদার তো গাছপালাই।
মঙ্গলের বাতাসে বসন্তকে ভরে দিচ্ছে অক্সিজেন?
কিন্তু এই সৌরমণ্ডলে আমাদের প্রতিবেশী লাল গ্রহে তো এখনও পর্যন্ত গাছপালার হদিশ মেলেনি। মেলেনি কোনও ধরনের প্রাণের বিন্দু-অস্তিত্বও। তা হলে মঙ্গলের খুব পাতলা হয়ে আসা বাতাসেকে জুগিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন, এখনও? তবে কি অণু-উদ্ভিদ বা অন্য কোনও ধরনের প্রাণ এখনও টিঁকে আছে লাল গ্রহে, যা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ভরে দিচ্ছে শ্বাসের বাতাস?
অধ্যাপক সুশীলের কথায়, ‘এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সভ্যতাকে পা রাখতে হবে মঙ্গলে। দেখতে হবে, লাল গ্রহের বসন্তেও প্রাণের বাড়তি সমারোহ হয় কি না, এখনও। নাকি তা শুধুই ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ই! যা-ই হোক মানতেই হবে, মঙ্গল একেবারেই নিষ্প্রাণ, সেখান থেকে আর কিছুই পাওয়া যাবে না, এটা বলার দিন বোধহয় শেষ হয়ে এল।’
নাসার রোভার ‘কিউরিওসিটি’ মঙ্গলের মাটিতে চষে বেড়াচ্ছে সাত বছর ধরে। পৃথিবীর ৬৮৭ দিনে একটা বছর হয় মঙ্গলে (মার্শিয়ান ইয়ার)। যার অর্থ, ২০১২ সাল থেকে মঙ্গলের তিনটি বছরে বসন্ত থেকে শীত আর গ্রীষ্ম, সব ঋতুতে দেখেছে কিউরিওসিটি। ফলে অনেকটা সময় ধরেই মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল জরিপ করার সুযোগ পেয়েছে নাসার পাঠানো রোভার।
কেন এই আবিষ্কারে অবাক হয়েছেন গবেষকরা?
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। শীতে লাল গ্রহের দুই মেরুতে সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড জমে বরফ হয়ে যায় বলে বায়ুমণ্ডলে তার পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। সেই হারিয়ে যাওয়া কার্বন ডাই-অক্সাইড আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে, বসন্তে। তাপমাত্রা বাড়লে। মঙ্গলে গরম কাল এলে।
মহাকাশের অতিবেগুনি রশ্মি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের একেবারে উপরের স্তরে (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ক্ষেত্রে যা আয়নোস্ফিয়ার) থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে ভেঙে দেয় কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস আর অক্সিজেন পরমাণুতে। সেই বায়ুমণ্ডল যত মঙ্গলের মাটির কাছাকাছি আসে, ততই মঙ্গলে থাকা পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে তা অক্সিজেন অণুর জন্ম দেয় লাল গ্রহে। সে ক্ষেত্রে সেই অক্সিজেন অণুর হদিশ মেলার সম্ভাবনাটা মঙ্গলের পিঠের (সারফেস) কাছেই বেশি।
ঘটনা হল অক্সিজেন অণু চট করে ভাঙে না। তা অনেক বেশি স্থায়ী। তাই গবেষকরা আশা করেছিলেন, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের পরিমাণে কোনও রদবদল ঘটবে না সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। ঋতু-চক্রে।
অধ্যাপক সুশীলের কথায় অনুযায়ী, কিন্তু কিউরিওসিটির পাঠানো তথ্যে যা দেখে আমরা খুবই অবাক হয়েছি তা হল; লাল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বসন্তে তিন গুণ বেড়ে গিয়েছে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীত ও গ্রীষ্মে তা অনেকটা কমেও গিয়েছে। আবার এই বাড়া-কমার হারটাও সব বছরে সমান হয়নি। কখনও তা একটু বেশি বেড়ে গিয়েছে। কখনও তা একটু কম। অথচ, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে থাকা নাইট্রোজন আর নিষ্ক্রিয় গ্যাস আর্গনের পরিমাণ কিন্তু এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে বাড়া, কমা করে না। এটা কেন হয়, এখনও জানতে পারিনি আমরা।
মূল গবেষক মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্টে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের মহাকাশবিজ্ঞানী মেলিসা জি ট্রেনার এই অক্সিজেনটা মঙ্গলের পিঠ থেকে উঠে এসেই বায়ুমণ্ডলে মিশছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। সেই সব অক্সিজেন অণুর জন্ম হতে পারে মঙ্গলে থাকা রাসায়নিক হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড এবং পারকোলেট থেকে।
একই কথা বলেছেন সুশীলও। তাঁর কথায়, এই অক্সিজেন মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে তৈরি হচ্ছে না। তৈরি হচ্ছে মঙ্গলের পিঠের কাছাকাছি। তবে ওই সব রাসায়নিক কেন এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে অক্সিজেন ছাড়া বা টেনে নেওয়ার পরিমাণ বাড়ায়, কমায়, তার কারণ জানা যায়নি।
অক্সিজেন অণু মিললেই প্রাণের সম্ভাবনা? দোটানায় বিজ্ঞানীরাও
তবে অক্সিজেন অণুর হদিশ মেলায় মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আরও জোরালো হল, মানতে চাইছেন না পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) সিনিয়র সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায়। গৌতম বলেছেন, ‘এই সৌরমণ্ডল বা ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও জল আর অক্সিজেন থাকলেই প্রাণ টিঁকে আছে বলে ধরে নেওয়াটা বোধহয় খুব যুক্তিগ্রাহ্য হবে না। কিছু দিন আগেই ‘হার্শেল হাই-ফাই’ যন্ত্রের তথ্যের ভিত্তিতে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন জেপিএল-এ আমার সহকর্মী পল গোল্ডস্মিথ। উনি দেখিয়েছিলেন নক্ষত্রের জন্মের সময় মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্তে শুধুই যে ওজোন গ্যাস বা অক্সিজেন পরমাণু তৈরি হচ্ছে, তা নয়: তৈরি হচ্ছে অক্সিজেন অণুরও। অথচ ব্রহ্মাণ্ডের সেই সব প্রান্তে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনার আশা করা হচ্ছে না।’
মঙ্গলে পাওয়া মিথেন গ্যাস নিয়েও রহস্য গভীর!
একই রহস্য রয়ে গিয়েছে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে হদিশ মেলা আরও একটি উপাদান মিথেন গ্যাসকে ঘিরেও। এ বছরের গোড়ার দিকে কিউরিওসিটির পাঠানো তথ্যাদির ভিত্তিতেই জানা গিয়েছিল, লাল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাসও। বস্তুত ২০০৩ সাল থেকেই বিভিন্ন সময়ের পর্যবেক্ষণে লাল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের অস্তিত্বের কথা জানা যেতে থাকে।
পৃথিবীতে মিথেন গ্যাস যে ভাবে তৈরি হয়েছে, তার ভিত্তিতে বলা যায়, মঙ্গলেও মিথেন তৈরি হতে পারে দু’ভাবে।
সুশীলের কথায়, ‘হয় অণুজীবই তাদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিচ্ছে ওই গ্যাস। না হলে, তা তৈরি হচ্ছে মঙ্গলেরই কোনও অভ্যন্তরীণ কারণে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে যাকে বলা হয় ‘জিওথার্মাল প্রসেস’। মঙ্গলেও যদি ওই দু’টি কারণেই মিথেন গ্যাসের জন্ম হয়ে থাকে, তা হলে লাল গ্রহে প্রাণের এখনও অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে যে আরও জোরালো করে তুলবে, তা নিয়ে অন্তত কোনও সন্দেহ নেই।’
তবে সেখানে রয়েছে আরও একটি রহস্য। কিউরিওসিটি মঙ্গলের ‘গেইল ক্রেটার’ এলাকার বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস পেয়েছিল। কিন্তু তার ঘণ্টাপাঁচেক পর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (‘ইসা’)-র ‘মার্স এক্সপ্রেস’ মহাকাশযান কক্ষপথে ঘোরার সময় লাল গ্রহের ওই এলাকার বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের সন্ধানই পায়নি।
সুশীল মনে করেন, এমন কিছু প্রক্রিয়া চলছে মঙ্গলের অভ্যন্তরে যা বায়ুমণ্ডলে যেমন মিথেন ভরে দিচ্ছে, তেমনই কিছু ক্ষণ পর বায়ুমণ্ডল থেকে সেই মিথেন গ্যাসকে টেনে বেরও করে নিচ্ছে। আর অত অল্প সময়ের মধ্যে মিথেন অণু কী ভাবে ভেঙে যেতে পারে, তারও কোনও উপায় আমরা জানি না এখনও পর্যন্ত।
এমএস/