ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রহস্যজনক: প্রধানমন্ত্রী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪০ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ বুধবার

রাজাকারের তালিকায় কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম গেল তা রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভার সূচনা বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন তিনি।

প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা প্রত্যাখ্যান করে তালিকার অসঙ্গতি নিজেই তুলে ধরেছেন তিনি। সেই সঙ্গে তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম কীভাবে এলো সেটা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করা হবে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রকাশিত রাজাকার তালিকা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গোলমাল করে ফেলেছে
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমাদের আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধে যারা গিয়েছিল তাদের সবার নামের একটা তালিকা করে সেখানে সন্ত্রাসী হিসেবে, দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে পাকিস্তান সরকার। সে সময় অনেকগুলো মামলা দেয়। যেটা পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওই তালিকা থেকে ধরে তাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় শাস্তি দিয়েছে বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। আবার এরশাদের সময়েও এটা ব্যবহার করা হয়েছিল।

একবার এক তালিকা বের হলো যে, কিশোরগঞ্জে এক নম্বর সন্ত্রাসী হলো জিল্লুর রহমান সাহেব, দুই নম্বর হলো হামিদ সাহেব। আমি যখন খোঁজ নিতে বললাম তখন দেখা গেল পাকিস্তান আমলে করা সেই তালিকাই সেখানে রয়ে গেছে। তখনি বলেছিলাম এটা মুছে ফেলতে। যদি সেটা থেকেই যায় তাহলে সেই রেকর্ডই রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে যেটা ভুল হয়েছে যে, তারা সেই তালিকায় ওখান থেকে কোলাবরেটর হিসেবে মামলা আছে, তাদের তালিকা নিতে গিয়ে সব মিলিয়ে একটা গোলমাল করে ফেলেছে। সেখানে অনেকের নাম চলে এসেছে যারা মুক্তিযোদ্ধা। সেখানে এক হাজারের মতো নাম বাদ দেওয়া ছিল, সেটা কীভাবে ওর মধ্যে ঢুকলো আর কীভাবে সেটা ওয়েবসাইটে চলে গেল এটা কিন্তু একটা রহস্যও বটে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষ
আসলে আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে বলেছিলাম, এটা তাড়াহুড়ো করে এখন করতে যায়েন না। কারণ, এ তালিকার মধ্যে কী আছে না আছে সব দেখে নিয়ে করতে হবে। আমি এই কথাগুলো তাকে বলতে চেয়েছিলাম। আমিও খুব ব্যস্ত ছিলাম। আমার সঙ্গে দেখা হলে বলতাম, তালিকা নিয়ে অনেক ঝামেলা মিলিটারি ডিকটেটররা করে রেখে গেছে।

কেন এটা দিল আমি জানি না। এটা দেওয়ার কথা ছিল না। বিশেষ করে বিজয় দিবসের আগে না। আর বিজয় দিবস এত চমৎকারভাবে, এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র বাংলাদেশে উদযাপন হয়েছে। এটা আসাতে যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার যারা আনন্দঘন পরিবেশে বিজয় দিবস উদযাপন করবে তাদের মনে কতটা আঘাত লাগতে পারে সেটা একবার চিন্তা করে দেখেন। সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারি। সেজন্য তাদের বলব কোনদিনই তারা রাজকারের লিস্টে থাকতে পারে না। এটা কখনো হতে পারে না। কাজেই এটা তারা নিশ্চিত থাকুক।

রাজাকারদের যে তালিকা তার গেজেট করা আছে। আইনগতভাবে গেজেট করা, আলবদরের গেজেট আলাদা, আল শামসের গেজেট আলাদা। সবগুলোর কিন্তু গেজেট নোটিফিকেশন করা আছে।

মানবতাবিরোধী হিসেবে আমরা যখন বিচার করতে শুরু করি তখন ওই গেজেট থেকেই তালিকা নিয়ে বিচার কাজ হয়েছে। কাজেই এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝির মতো সৃষ্টি হয়েছে।

যাই হোক, আমি নির্দেশ দিয়েছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও বলেছি— এইভাবে সমস্ত ফাইল খুলে দিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। আর এখন যা অবস্থা অনেকে জানে না, অনেকের সে সময় জন্মও হয়নি, যার জন্য তাদেরও ওই অভিজ্ঞতা থাকার কথা না। কাজেই এ জিনিসটা খুব খারাপ একটা কাজ হয়ে গেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম সেখানে ঢুকে গেছে। কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার খেতাব দেওয়া হবে না, এটা হতে পারে না, এটা অসম্ভব।

ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ
এটা (তালিকা) চলে আসাতে খুব স্বাভাবিক একটা মানুষের কষ্ট লাগবে। যার পরিবারের মানুষ শহীদ হলো, যারা এত কষ্ট করলো তারপর যারা মুক্তিযুদ্ধ করলো তাদের যদি রাজাকার বলা হয়, এর থেকে দুঃখের কষ্টের আর কিছু থাকে না। যারা এ দুঃখ পেয়েছেন তাদের আমি বলবো যে, তারা যেন শান্ত হন। এবং ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। যেহেতু সরকারপ্রধান, আমারও একটু শক্ত হয়ে বোধ হয় বলা উচিত ছিল।

যারা কষ্ট পেয়েছেন, দুঃখ পেয়েছেন তাদের বলবো দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। যারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, শহীদ পরিবার তারা সবসময় আমাদের কাছে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। তারা জাতির কাছে সবসময় শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন। এর কোনো ব্যত্যয় হবে না।

মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে মামলা
পাকিস্তান আমলে করা তালিকা, একটা গোলমাল। আসলে পনের আগস্টের পর জিয়াউর রহমান সেই তালিকা ব্যবহার করেছে। এরশাদ ব্যবহার করেছে, খালেদা জিয়া ব্যবহার করেছে।

যারাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে তাদের তারা সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে মামলাও দিয়েছে। এ ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের দিয়ে তৈরি তালিকাগুলো নিয়ে গোলমাল হতো না, যদি জিয়াউর রহমান বা এরশাদ ব্যবহার না করত। এটা করতে গিয়ে সন্ত্রাসী বানাতে গিয়ে একটা গোলমাল করে গেছে। সেগুলো মন্ত্রণালয় দিয়ে দিয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই না করে তারা এটা ওয়েবসাইটে দিয়ে এখানে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

রাজাকারদের সম্পর্কে একাত্তরের পত্রিকাগুলো ঘেটে দেখলেও দেখতে পাবেন— ট্রাইব্যুনাল যখন হয় তখন করাচি থেকে অনেক পত্রিকার কাটিং কিন্তু আমরা নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো আমরা সংগ্রহ করেছি।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ওই স্বাধীনতাবিরোধীদের আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসা, তাদের মন্ত্রী বানানো এইগুলি করার ফলে ওরা সবসময় একটা জায়গা পেয়ে গেল। তারাই সামনে চলে এলো। এবং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় এদের বহু নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। প্রত্যেকবারই এই ঘটনা ঘটেছে। কাজেই এভাবে সব জায়গায় একটা এনামলি সৃষ্টি করে রেখে গেছে। এই আবর্জনাগুলি, জঞ্জালগুলি আমাদের পরিষ্কার করতে হবে।

বিপ্লবের পর বিবর্তন হয়
আমাদের দেশে গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে। গেরিলা যোদ্ধারা সাধারণত যেটা করে— গেরিলাদের আসা, থাকা, অস্ত্র রাখা, যুদ্ধ করা। তাদের জন্য কিন্তু শেল্টার দরকার হয়। সারা বাংলাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, চেয়ারম্যান, মুরুব্বিরা বৈঠক খানায় বসে থেকেছে। শান্তি কমিটির সদস্য ছিল হয়ত, মা-বোনেরা ভাত রেঁধেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে দিয়েছে, তাদের অস্ত্র রেখেছে, তাদের খবর দিয়েছে। এরা সামনে থেকেছে এই কারণে যাতে তাদের বাড়িতে কখনো আর্মি না আসে, ঢুকতে না পারে, যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে না পারে। তাদের শেল্টার দিয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সবধরনের সহায়তা তাদের দিয়েছে। এ কারণে জাতির পিতা অনেককে সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করেছেন। যেখানেই বিপ্লব হয়, গেরিলা যুদ্ধ হয় সেখানেই কিন্তু এটা একটা নিয়ম।

পাকিস্তানিরা যখন জানলো যে, ওদের আর সময় নেই। সারেন্ডার করতে হবে। তখন ওরা যাকে তাকে অস্ত্র গুলি দিয়ে যায়। যার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পর একটা কথা ছিল যে সিক্সটিন ডিভিশন সৃষ্টি হয়েছে। যারা আমাদের পক্ষেও ছিল না, এরা রাতারাতি হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। এরকম ঘটনাও কিন্তু ঘটেছে। একটা বিপ্লবের পর এ ধরনের একটা বিবর্তন হয়। যদি জাতির পিতা ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকতো, আমাদের জীবনে ১৫ আগস্ট না ঘটতো তাহলে এগুলি পরিষ্কার হয়ে যেত।

আরকে//