ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হচ্ছে প্যালিয়েটিভ কেয়ার

তানভীরুল ইসলাম

প্রকাশিত : ১০:৪৬ এএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:০৭ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

জন্মের পর মানুষের জীবনের শেষ পরিণতি হচ্ছে ‘মৃত্যু’। সেই ‘মৃত্যু’ অবধারিত হলেও সকলের প্রত্যাশা থাকে বেদনাহীন, যন্ত্রণাহীন, মর্যাদাপূর্ণ নিরাপদ ‘মৃত্যু’র। কিন্তু অনেক সময় সেটি হয়ে ওঠে না, নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। ফলে শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। চিকিৎসাব্যবস্থায় নিরাময়-অযোগ্য, জীবন সীমিত হয়ে আসা রোগীদের সর্বাত্মক পরিচর্যা প্রদানের জন্য তৈরি হয়েছে এক বিশেষ ব্যবস্থা। যার নাম ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি। বিশ্বব্যাপী বারবার মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, আরোগ্য হওয়ার নয় এমন রোগীদের রোগ নির্ণয়ের শুরু থেকেই এ চিকিৎসাব্যবস্থার আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়।

নিজের জন্য, প্রিয়জনের জন্য, সমাজের সবার জন্য এটি নিশ্চিত করা জরুরী। যারা নিরাময়-অযোগ্য, জীবন সীমিত হয়ে আসা রোগে আক্রান্ত মানুষকে ব্যথানাশকের চিকিৎসা দেন, শ্বাসকষ্ট কমাতে সাহায্য করেন, সর্বাত্মক পরিচর্যা করে ভোগান্তি কমাতে সচেষ্ট থাকেন এবং রোগীর পরিবারকে এ সংকট অবস্থা মোকাবেলায় সহায়তা করেন, তাদের বলা হয়ে থাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ। এ সেবা ব্যবস্থাটির নামই হচ্ছে প্যালিয়েটিভ মেডিসিন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বড় বড় হাসপাতালে যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ আছে, তেমনি আছে রোগী যখন আর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না তখন তাদের জন্য বাড়িতে এ পরিচর্যা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা হোম কেয়ার সার্ভিস।

বাংলাদেশের সরকারি কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাব্যবস্থায় প্যালিয়েটিভ মেডিসিনের অস্তিত্ব ছিল না। বেসরকারি দু-একটি উদ্যোগ ছিল, বিশেষ করে শিশুদের জন্য, যারা আর্থিক সংকট আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভালোভাবে দাঁড়াতে পারছিল না। সেখানে ছিল না প্রশিক্ষিত জনবল। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে একটি বহির্বিভাগ চালু ছিল ২০১১ সাল পর্যন্ত। এরপর ২০১১ সালে দশটি পুরুষ শয্যা আর নয়টি মহিলা শয্যা নিয়ে চালু করা হয় প্রথম প্যালিয়েটিভ কেয়ার ওয়ার্ড। প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের একমাত্র সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্বাস্থ্যসেবা খাতে যেসব ভূমিকা রাখতে পারে সেগুলো হল-
- জীবন ধ্বংসকারী অসুখে, জীবন সায়াহ্নে রোগী ও তার পরিবারের পরিচর্যা করা।
- অহেতুক রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে রক্ষা করে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী করা।
- রোগীকে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ভোগান্তি লাঘবে সাহায্য করা।
- এ স্বাস্থ্যসেবা দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল বা হস্পিস এবং বাড়িতে দেয়া সম্ভব।
- এ সেবার মাধ্যমে রোগীর জীবনের মানোন্নয়ন সম্ভব।
- স্বেচ্ছাসেবক বা যে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর মাধ্যমেই এ সেবা দেয়া সম্ভব।

অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে- কাদের এ ধরনের অন্তিম স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৪ কোটি মানুষের জন্য এ স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। যার মধ্যে ৩৯ ভাগ হৃদরোগজনিত জটিলতার জন্য, ৩৪ ভাগ ক্যান্সারজনিত রোগাক্রান্তের জন্য, ১০ ভাগ ফুসফুসজনিত রোগের জন্য, ৬ ভাগ এইচআইভি/এইডস, ৫ ভাগ ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার জন্য, অন্যান্য ব্যাধির জন্য ৬ ভাগ।

একই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ৮৬ ভাগ মানুষ যাদের প্রশমন সেবা প্রয়োজন তারা সেটা পাচ্ছেন না। বিশ্বে ৮৩ জন ব্যথানাশক ওষুধ পান না। প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা প্রয়োজন এমন জনসংখ্যার ৯৮ ভাগ বাস করেন নিচু ও মধ্যবিত্ত পরিবারে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা প্রদানের সমস্যা কী?
সাধারণভাবে বলা যেতে পারে-
- সাধারণ মানুষ ধারণাটির সঙ্গে পরিচিত নয়, সবাই একটি আরোগ্যনির্ভর মৃত্যুকে অস্বীকার করার প্রবণতা নিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থার শরণাপন্ন হন।
- রোগজনিত কারণে ব্যথা এবং মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংস্কার রয়েছে বেশকিছু।
- দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর অভাব।
- আফিমজাতীয় ব্যথানাশকের প্রতি সরকারি কঠিন নিষেধাজ্ঞা এবং চিকিৎসকদের ভ্রান্ত ধারণা এবং পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের অভাব।

এসব বাধা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাব্য করণীয় পদক্ষেপ :
- জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে অন্তর্ভুক্তি করা।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যথানাশক ওষুধ অর্থাৎ আফিমজাতীয় ট্যাবলেট বা ইনজেকশন আমদানিতে আইনের শিথিলতা প্রয়োগ।
- স্বাস্থ্য সেবকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া।
- কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ার সার্ভিস চালু করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেয়া নিশ্চিত করা।
- প্রত্যেক মেডিকেল কলেজ, জেলা হাসপাতাল ও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ ধরনের সেবা চালু করা।

২০১১ সালে শুরু করলেও বাংলাদেশ এখন আর শূন্যের কোঠায় নেই। অনেক উন্নতি হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশ এখন ৭৯তম স্থানে। সূচক শতকরায় ১৯। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ মাত্র ১.৩ শতাংশ। মানবিক বিবেচনায় যা দরকার, তা হল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বা সমমানের সব প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাই এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।

যে কারও পরিবারে যে কোনো সদস্যের এ সেবা যে কোনো সময়ে প্রয়োজন হতে পারে। দেশের সরকার স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট উন্নয়ন অর্জন করেছে, যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে। তথাপি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মতো স্বল্প ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা সর্বস্তরে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। যা করা খুবই জরুরী।
এসএ/