জুমার দিনে খুতবার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:৪১ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ শুক্রবার
খুতবা পাঠ ইসলামী শরীয়াহ’র এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খুতবা সাধারণত আরবি ভাষায় পাঠ করা হয়ে থাকে। তবে কিছু স্থানে স্থানীয় ভাষায় খুতবা দেয়ার প্রচলন রয়েছে।
খুতবা মূলত নামাজের আগেই পাঠ করা হয়। এর গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে নামাজের অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর কুবার মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। এতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই ইমামতি করেন। এদিন জুমার নামাজের আগে তিনি দুটি খুতবা প্রদান করেন। তখন থেকেই শুক্রবারে জুমার নামাজের জামাতের আগে দুটি খুতবা প্রদানের প্রথা প্রচলিত।
খুতবার শাব্দিক অর্থ বক্তৃতা বা বক্তৃতা করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় খুতবা বলা হয় এমন বক্তৃতা, যাতে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা, তাঁর একত্ববাদের ঘোষণা, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি দরুদ এবং উপস্থিত সাধারণের প্রতি উপদেশ বিদ্যমান থাকে।
শুধু জুমা নয়, উভয় ঈদের নামাজের পরে, হজে আরাফার দিনে মসজিদে নামিরাতে, বিয়ের অনুষ্ঠানে ও বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে খুতবা প্রদান করা হয়ে থাকে। যিনি খুতবা দেন তাকে ‘খতিব’ বলা হয়।
গোটা পৃথিবীর মুসলিমদের নিকট জুমার দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ও তাঁর রাসূল (সাঃ) অনেক আলোচনা করেছেন। বিশ্বব্যাপী এ দিনটি একই নিয়ম ও একই ধারায় পালন করা হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) এ দিনের আমল উম্মতদের শিখিয়েছেন।
জুমার নামাজের আগে খুতবা দেয়ার এ প্রচলন কেয়ামত পর্যন্ত ওয়াজিবও করা হয়েছে। ফলে জুমার দিনের সব আমলের মাঝে অন্যতম জায়গা করে আছে জুমার খুতবা। যে খুতবা পড়ার সময় কোনো মুসল্লির জন্য কথা বলা কিংবা ইশারা দেওয়াও নিষেধ করা হয়েছে।
নবী (সা.) জুমার নামাজের আগে ‘খুতবা’ বা বয়ান-বক্তৃতায় বিভিন্ন উপদেশমূলক কথা বলতেন। আত্মগঠনের কথা বলতেন। সাহাবাদের ঈমান ও আমলের ব্যাপারে সতর্ক করতেন।
বর্তমানে অনারব দেশগুলোয় আরবি খুতবার সঙ্গে মাতৃভাষায়ও বয়ান ও ওয়াজ করা হয়ে থাকে। জনসাধারণ ব্যাপকভাবে আরবি জানা না থাকার কারণেই নিজ নিজ ভাষায় জুমার নামাজের আগে বয়ান হয়ে থাকে। সতেচন খতিবরা খুতবাপূর্ব বয়ানের সারমর্মই আরবি খুতবায় বলে থাকেন।
ইসলামে জুমার খুতবা ও বয়ানের তাৎপর্য সীমাহীন। একটি ঘুণে ধরা সমাজকে জাগাতে, মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী সমাজে ঈমানের আলো জিইয়ে রাখতে জুমার বয়ান শত শত বছর ধরে ভূমিকা রেখে আসছে। খতিবদের ওয়াজ নসিহত ও সমাজসচেতন বয়ান মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঈমানের গতি ছড়ায়। জীবনকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহ দেয়। পাপ পঙ্কিলতামুক্ত জীবন গঠনে প্রেরণা জোগায়।
সমাজ বিনির্মাণের শুদ্ধতম চাবিটি রয়েছে খতিবগণের হাতেই। জুমার মিম্বার থেকে সে আলো ছড়িয়ে পড়ে মন থেকে মনে, সমাজ থেকে সমাজে। এ মিম্বর থেকে একজন খতিব সত্য ও ন্যায়ের বার্তা দেন। কথা বলেন সমাজে প্রচলিত অন্যায়-অবিচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, মজুতদারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির বিরুদ্ধে।
সামাজিক অনাচার ও গরিব-মিসকিন, অনাথ আত্মীয়স্বজন, অভাবগ্রস্ত পাড়া-প্রতিবেশী, অভুক্ত অনাহারী ও আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান খতিবরা। জুমার মিম্বর থেকে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণীর সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আদর্শ জাতি গঠনে ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা হয়।
সমাজ জনসাধারণে আত্মশুদ্ধি গঠনে জুমার মিম্বর যে ভূমিকা রাখে অন্য কোনো উপায় ততটা কার্যকরি নয়। ওয়াজ নসিহত ও শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি জুমার মিম্বরই সর্বসাধরণের জন্য জীবন গঠনের নিয়মতান্ত্রিক কার্যকরি উপায়। ফলে খতিবদের দায়িত্বের বোঝাটাও অনেক ভারী।
আর এ ভার একজন দক্ষ ও সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একজন যোগ্য আলেমের কাঁধে ন্যস্ত না হলে সমাজ বিপদগামী হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। অপরদিকে খতিবদের ওপর সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হলেও সত্য ও ন্যায়ের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওই সমাজের অধঃপতনও অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে!
জুমার খুতবায় সত্য ন্যায়ের বার্তা দেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)। নবীজি (সা.)-এর জুমার খুতবা ছিল ওয়াজ তথা নসিহত ও দিকনির্দেশনামূলক। নবীজির (সা.) খুতবায় নসিহত ও উপদেশমূলক কথা বেশি বলা হতো এবং সেগুলোও সাহাবায়ে কেরাম স্বাভাবিক হাদিসগুলোর অধীনে বর্ণনা করে দিয়েছেন।
সাহাবায়ে কেরাম জুমার নামাজ এবং নবীজির খুতবা সংক্রান্ত সবকিছু বর্ণনা করেছেন এবং খুতবার সময় নবীজি (সা.)-এর সার্বিক অবস্থা কী ছিল, তাও সাহাবিরা পরবর্তীদের জানিয়ে গেছেন।
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘খুতবার সময় নবীজির চোখ দুইটি লাল হয়ে যেত, স্বর উঁচু হয়ে যেত এবং রাগ বেড়ে যেত; যেন তিনি কোনো বাহিনীকে সতর্ক করছেন!’ (মুসলিম: ৮৬৭)। এ হাদিস থেকে বুঝে আসে সাহাবাদের জীবন গঠনে জুমার খুতবা নবীজি (সা.) কতটা গুরুত্বের সঙ্গে প্রদান করতেন। সতর্ক করতেন মুসলিম উম্মাহকে।
জুমার খুতবা প্রদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, জুমার খুতবা শোনাও গুরুত্বপূর্ণ। যথাসময়ে জুমার নামাজ আদায় ও খুতবা শোনার জন্য আজান শুনা মাত্রই ব্যবসা বাণিজ্য ও সব কাজ-কর্ম বন্ধ করে মসজিদের দিকে দ্রুত গমনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কোরআনুল কারিমে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহ্বান করা হবে তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সূরা জুমা : ৯)।
আর খুতবা জুমার নামাজের অংশ উল্লেখ করে খুতবা শোনার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে রাসূল (সা.) বহুবার আলোচনা করেছেন। তবে যদি মুসল্লি বেশি হওয়ার কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে খুতবার আওয়াজ না শোনা যায়, তবে নিরব থাকা নিয়ম বলেও আলেমরা জানান।
আবু হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমভাবে ওজু করে জুমার নামাজে এলো, নীরবে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনলো, তাহলে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং আরও অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করলো, সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৮৭৩)
আবু হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন যখন তোমার পাশের মুসল্লিকে চুপ থাকো বলবে, অথচ ইমাম খুতবা দিচ্ছেন, তা হলে তুমি একটি অনর্থক কথা বললে। (বুখারি, হাদিস: ৯৩৪, মুসলিম, হাদিস: ৮৫১)
কুরআন ও হাদিসে খুতবার এ মহত্ব আলোচনা করা হলেও, আমাদের সমাজের চিত্র উল্টো। জুমার আজান হলেও প্রতিদিনের মতোই অব্যাহত থাকে কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য। অনেকের কাছে কোনো রকম নামাজ আদায় করাটাই যথেষ্ট। আজান শুনার পর এ ধরনের কাজ-কর্মকে ইসলামে অপছন্দনীয় ঘোষণা করা হয়েছে।
জুমার নামাজ আদায়, খুতবা প্রদান ও শুনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া ঈমানের দাবি। এ দাবি মানা হলে সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারমুক্ত সমাজ গঠনের হাতিয়ার হবে জুমার মিম্বর। জেগে উঠবে সমাজ। ঈমানের আলো ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।
এআই/