ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

ভাওয়াইয়া কিংবদন্তী আব্বাসউদ্দীনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৪৪ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১১:৪৯ এএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ সোমবার

লোকসঙ্গীতের রাজা আব্বাসউদ্দীন আহমদ ছিলেন সঙ্গীতশিল্লী, সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘তোরষা নদী উথাল পাতাল’, কিংবা ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান’ -এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গানের অমরশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লী গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়। এই গুণী ব্যক্তির আজ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এই মহান সঙ্গীতশিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।

যে কোনো গান একবার শুনেই সুমধুর কণ্ঠে আয়ত্ব করতে পারতেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি প্রথম গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দিন আহমদ। এই গানটি এমন একটি গান যে গান না শুনলে আমাদের সংস্কৃতিতে রোজার ঈদকে ঈদই মনে হয় না। গজলেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মুহাম্মদ’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ইত্যাদি গান গেয়ে তিনি সমগ্র বাংলার মানুষকে মাতোয়ারা করেছিলেন। 

বিশ শতকের গোড়ার দিকে বঙ্গীয় মুসলিম পরিবারে সঙ্গীতচর্চা ছিল কল্পনার অতীত। সেই সময় স্কুল-কলেজে ছাত্রাবস্থায়, বিভিন্ন সঙ্গীতের আসরে ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আব্বাসউদ্দীন গান শুনে শুনে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। লোকসঙ্গীত, আধুনিক গান, দেশাত্মবোধক গান, ইসলামী গান ও উর্দু গান গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন। তবে বাংলা লোকসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। 

লোকসঙ্গীতের প্রায় সব ধারাতেই আব্বাসউদ্দীনের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ ছিল। এক সময় ভাওয়াইয়া, চটকা, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, বিচ্ছেদি, মর্সিয়া, দেহতত্ত্ব ও পালাগানের প্রতিটি ক্ষেত্রে আব্বাসউদ্দীন ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ও কবি গোলাম মোস্তফার লেখা অনেক গান গেয়েছেন। সেই সূত্রে এই তিন বিখ্যাত কবির সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের বিশেষ সখ্য গড়ে ওঠে।

১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তাঁর পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অণুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করেন।

ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর নিকট উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষা নেন আব্বাসউদ্দীন। পণ্ডিত শাকিল রাসেলের রেফারেন্স অনুযায়ী রংপুর ও কুচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া ভাভাগো ভাভা, ক্ষীরোল চটকা গেয়ে আব্বাস উদ্দীন প্রথমে সুনাম অর্জন করেন। তারপর জারি, সারি, ভাটিয়ালি , মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালা গান ইত্যাদি গান গেয়ে জনপ্রিয় হন। তিনি তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠে পল্লি গানের সুর যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও অদ্বিতীয়। 

আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করেছিলেন। বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পেয়েছিল তাঁর রেকর্ডগুলো। তাঁর এই সাফল্যে হিন্দু ধর্মের গায়করা মুসলমান ছদ্মনাম ধারণ করে গান করতে থাকেন।

শিল্পীজীবনে আব্বাসউদ্দীন ঢাকা-কলকাতাসহ দুই বাংলার ছোট-বড় অনেক শহরে এমনকি গ্রামগঞ্জেও অসংখ্য অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া অগণিত গান গ্রামোফোন রেকর্ড করেছে কলকাতার বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ ও ‘মেগাফোন’। বিশ শতকের প্রথমার্ধে রক্ষণশীল বাঙালি মুসলিম পরিবারে সঙ্গীত তথা লোকসঙ্গীতকে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলার কৃতিত্ব বলতে গেলে আব্বাসউদ্দীনের একার।

আব্বাসউদ্দীন শুধু একজন সঙ্গীতশিল্পীই ছিলেন না, তার আরও অনেক গুণ ছিল। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও অমায়িক লোক ছিলেন। পারিবারিক জীবনে তিনি একজন সুখী স্বামী এবং একজন সার্থক বাবা ছিলেন। তিনি নিজে যেমন ধার্মিক ছিলেন, তেমনি ছেলেমেয়েদের ইসলামের সঠিক তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে গেছেন।

ছেলে মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মেয়ে ফেরদৌসী রহমান, নাতনীদ্বয় নাশিদ কামাল ও সামিরা আব্বাসী এবং নাশিদ কামালের মেয়ে আরমিন মূসা আব্বাসউদ্দীনের যোগ্য উত্তরসূরি।

আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বিষ্ণুমায়া, মহানিশা, একটি কথা ও ঠিকাদার বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ঠিকাদার সিনেমায় একজন কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন আব্বাসউদ্দিন। ‘আমার শিল্পীজীবনের কথা’ আব্বাস উদ্দীনের রচিত একমাত্র গ্রন্থ। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর ১৯৬০ সালে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে ‘শিল্পকলা একাডেমী’ পুরস্কার ও ১৯৮১ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কারে ভূষিত হন।

এএইচ/