ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

যেভাবে হারিয়ে গেল ঢাকাই মসলিন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:০৮ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার

মসলিন বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সূতা দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়বিশেষ। এটি ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী খ্যাত। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হত যার মধ্যে জামদানি এখনও ব্যাপক আকারে প্রচলিত।

ঢাকা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানীয় কারিগরদের দ্বারা স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন সুতা থেকে এই মসলিন তৈরি হত। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ঢাকাই মসলিনের বেশ চাহিদা ছিল। কিন্তু নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলায় মসলিন বয়ন বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলার বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। তবে মুগল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি বেড়ে যায় এবং তা দূর-দূরান্তের বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। মুগল সম্রাট ও অভিজাতগণ ঢাকার মসলিন শিল্পের প্রসারে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সম্রাট, প্রাদেশিক শাসনকর্তা এবং পদস্থ কর্মকর্তা ও অভিজাতদের ব্যবহারের জন্য প্রচুর পরিমাণে সূক্ষ্মতম মসলিন বস্ত্র সংগ্রহ করা হত। ১৮৫১ সালে লন্ডনের বিশাল প্রদর্শনীতে ঢাকাই মসলিন বিশেষ প্রাধান্য পায় এবং বিপুল সংখ্যক দর্শককে মুগ্ধ করে। ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকা ঢাকাই মসলিন বস্ত্রের উৎকর্ষ ও সূক্ষ্মতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে।

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী কোনও কোনও এলাকায় ফুটি নামে এক প্রকার তুলা জন্মাত। এর সুতা থেকে তৈরি হত সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র। অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের আরও দুই ধরনের তুলা ছিল বয়রাতি ও দেশি এবং এগুলো উৎপন্ন হত ঢাকার বিভিন্ন অংশে ও আশপাশের এলাকায়। এসব তুলা দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম সূক্ষ্ম ও মোটা কাপড় তৈরি হত। তুলা ধুনা, সুতা কাটার প্রক্রিয়া ও বস্ত্র বয়নের সঙ্গে জড়িত সবাই ছিল তাঁতী পরিবারের। ছোট পরিবার হলে দু’তিনটি পরিবার এক সঙ্গে মিলে কাপড় বুননের কাজ করত। ঢাকার তাঁতীদের তৈরি কাপড়ের মান বিভিন্ন ধরনের হত। সম্রাট, উজির, নওয়াব প্রমুখ অভিজাত শ্রেণির জন্য বুনা হতো সূক্ষ্ম ও মিহি বস্ত্র এবং দরিদ্রদের জন্য মোটা ও ভারি কাপড়। কাপড়ের সূক্ষ্মতা ও স্বচ্ছতা, উৎপাদনের উৎস এবং ব্যবহার ভেদে ঢাকাই মসলিনের বিভিন্ন নাম দেওয়া হত। নামগুলো ছিল মলমল (সূক্ষ্মতম বস্ত্র), ঝুনা (স্থানীয় নর্তকীদের ব্যবহূত বস্ত্র), রঙ্গ (স্বচ্ছ ও জালিজাতীয় বস্ত্র), আবি-রাওয়ান (প্রবহমান পানির তুল্য বস্ত্র), খাস (বিশেষ ধরনের মিহি বা জমকালো), শবনম (ভোরের শিশির), আলাবালি (অতি মিহি), তনজিব (দেহের অলঙ্কার সদৃশ), নয়ন-সুখ (দর্শন প্রীতিকর), বদন-খাস (বিশেষ ধরনের বস্ত্র), শিরবন্দ (পাগড়ির উপযোগী), কামিজ (জামার কাপড়), ডোরিয়া (ডোরা কাটা), চারকোণা (ছক কাটা বস্ত্র), জামদানি (নকশা আঁকা) ইত্যাদি।

সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিনের নাম ছিল মলমল। বিদেশি পর্যটকরা এই মসলিনকে কখনও কখনও মলমল শাহী বা মলমল খাস নামে উল্লেখ করেছেন। এগুলো বেশ দামি এবং এরকম এক প্রস্থ বস্ত্র তৈরি করতে তাঁতীদের দীর্ঘদিন, এমনকি ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেত। এই বস্ত্র সম্রাট ও নওয়াবগণই ব্যবহার করতেন। সম্রাটদের জন্য সংগৃহীত বস্ত্রের নাম ছিল মলবুস খাস এবং নওয়াবদের জন্য সংগৃহীত বস্ত্রের নাম ছিল সরকার-ই-আলা। মুগল সরকার সম্রাট ও নওয়াবদের ব্যবহার্য মসলিন প্রস্ত্তত-কার্য তদারকির জন্য দারোগা বা দারোগা-ই-মলবুস খাস উপাধিধারী একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। দীউয়ান ও পদস্থ কর্মকর্তা এবং বিখ্যাত ব্যাঙ্কার জগৎ শেঠ এর জন্যও মলমল সংগ্রহ করা হত। মলমল (বা মলবুস খাস ও সরকার-ই-আলা) ব্যতীত অন্যান্য মসলিন বস্ত্র ব্যবসায়ীরা রফতানি করত। স্থানীয় লোকেরাও কিছু কিছু মসলিন বস্ত্র ব্যবহার করত।

আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ওসটেন্ড কোম্পানিও বাংলায় আগমন করে। তারা ঢাকাই মসলিন সংগ্রহ করত দালাল, পাইকার ও নিজস্ব কর্মচারীদের মাধ্যমে। মসলিনের রফতানি বাণিজ্য সবচেয়ে লাভজনক দেখে তারা ঢাকায় কুঠি স্থাপন করে। সতের শতকের প্রথম এবং কার্যত এই শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পর্তুগিজদের বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। ওলন্দাজরা ঢাকায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে, ইংরেজরা ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এবং ফরাসিরা ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে। পূর্বে ইরানি ও আরমেনীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মসলিন ইউরোপে পৌঁছাত। কিন্তু বাংলায় ইউরোপীয় কোম্পানির আগমন ও বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাই মসলিনের রফতানি প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং মসলিন ইউরোপের বাজার দখল করে। ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর রফতানি বাণিজ্য এতই বেড়ে যায় যে, বর্ধিত ব্যবসায়ের যোগান দেওয়ার জন্য তারা খোদ ঢাকায় বসতি স্থাপন ও কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়।

স্থানীয় বাজারে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর আমদানিকৃত পণ্যের চাহিদা তেমন ছিল না। তাই তারা বাংলা বিশেষত ঢাকার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করার জন্য কাঁচা টাকা ও সোনা-রূপা আমদানি করত।

পলাশীর যুদ্ধ এর পর ঢাকার মসলিন শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে এবং আঠারো শতকের শেষ দিকে ঢাকাই মসলিনের রফতানির পরিমাণ ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসে।

মুগল বাদশা, নওয়াব ও পদস্থ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই ঢাকাই মসলিন শিল্পের অবনতির কারণ। মুগলরা কেবল শাসন ক্ষমতা ও মর্যাদাই হারায়নি, একই সঙ্গে তাদের ক্রয় ও ব্যয় করার ক্ষমতাও লুপ্ত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর (১৭৫৭) বাংলার ব্যবসাক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের ফলে ইউরোপের অন্যান্য কোম্পানি এবং বিভিন্ন দেশের বণিকদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তবে মসলিন শিল্পের অবনতি ও চূড়ান্ত বিলুপ্তির সর্বপ্রধান কারণ ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এবং আধুনিক বাষ্পশক্তি ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার। এভাবে ইংল্যান্ডের শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত সস্তা দামের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যায় ঢাকার মসলিনের মতো দামি সূতিবস্ত্র।

ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ঊনবিংশ শতাব্দিতে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করা বস্ত্রের উপরে ৭০ হতে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত-করা আমদানিকৃত কাপড়ের ওপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিল। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের তাঁতশিল্পে ধস নামে।

ইতিমধ্যেই মোগল শাসনের জৌলুস কমে আসে, মোগল তাঁতখানার সবেচেয়ে অভিজ্ঞ তাঁতীরা দারিদ্র্যে আর অনাহারে পেশা পরিবর্তন করে। ভারতের বিভিন্ন স্থানীয় রাজা এবং মোগলদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলা তাঁতখানা নিরব হয়ে যেতে শুরু করে। অভিজ্ঞ আর দক্ষ তাঁতীদের জ্ঞান পরের প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের সুযোগ কমে আসে, আর বাংলায় বিশেষ করে ঢাকার আশেপাশে মসলিনের তাঁতখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারিগরদের পলায়ন ইত্যাদি কারণে মসলিনের প্রধান কাঁচামাল ফুটি কার্পাসের চাহিদা কমে আসে, ওই জমিতে বিকল্প চাষাবাদ শুরু হয়। 

কিছুদিন অল্প স্বল্প করে চললেও একসময় সেটাও ফুরিয়ে আসে। বিশ্বজোড়া যে মসলিনের খ্যাতি ছিল সেই মসলিন একসময় হারিয়ে গেল।

লোকশ্রুতি আছে ইংরেজরা দক্ষ মসলিন তাঁতীদের হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল। তবে এমন তথ্যের ঐতিহাসিক দলিল কিংবা সত্যতা যাচাই করা যায়নি। তবে সময়মতো মসলিন যোগান দিতে না পারলে তাঁতীদের উপরে অত্যাচার করা হত। তবে অন্য আরেকটি দাবি বেশ যৌক্তিকভাবে সামনে উঠে এসেছে। তা হলো, তাঁতীদের হাত ব্রিটিশরা নয়, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আঙ্গুল কেটে নিত, যাতে এই তাঁতের কাজ আর না করতে হয়।

ইউরোপীয় বণিকরা অন্যান্য অনেক কৃষিজাত পণ্যের পাশাপাশি নীলের সুলভতার কারণেই ভারতবর্ষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরে পর্তুগিজরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাবার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করলে সেখান থেকেই গোটা ইউরোপের বাজারে সরবরাহ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ নীল আমদানি শুরু করে। সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজরা নীল ব্যবসায় পর্তুগিজদের একচেটিয়া সুবিধা নষ্ট করে দেয়। এরপর ইংরেজরাও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু করে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার পর তারা এদেশীয় চাষীদের দ্বারা কম খরচে নীল উৎপাদন শুরু করে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও ক্লেশময় সামাজিক সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে আছে এই নীলচাষের ইতিহাস।

‘নীলচাষ’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো ইংরেজ সাহেবের হাতে চাবুক, অসহায় কৃষকের চোখে জল, নিরুপায়ের আহাজারি ও ক্ষুধার হিংস্র থাবা। এখনও বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক নীলকুঠি।

একে//