ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

এক যুগ ধরে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছেন গবি শিক্ষক

গবি সংবাদদাতা

প্রকাশিত : ০৫:২৭ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০২০ সোমবার

দিনভর নিতে হয় অনেকগুলো ক্লাস, পরীক্ষা ও ল্যাব। ক্লাসের মাঝে কখনো থাকে স্বল্প সময়ের বিরতি। বিরতিতে কখনো চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নেওয়া হয় পরবর্তী ক্লাসের প্রস্তুতি। আবার কখনো বা সেই সুযোগটাও থাকে না। স্বল্প সময়ের বিরতিতেই  চিকিৎসা দিতে হয় অফিসে অপেক্ষমান রোগীদের। 

রোগীদের কেউ শিক্ষার্থী কেউ অভিভাবক, কেউবা ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অথবা ক্যাম্পাস এলাকার অধিবাসী। স্বল্প সময়ের বিরতিতেই  হাসিমুখে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন রোগীদের। তবে নিচ্ছেন না কোনো ফি। এমনকি অনেক সময় দিয়ে দিচ্ছেন প্রাথমিক ঔষধ। 
এভাবেই সারাদিনের ক্লান্তিভরা শরীর নিয়েই ক্যাম্পাসের কাজ শেষ করে বাসায় অল্প সময়ের বিশ্রাম নিয়েই আবার রোগী দেখছেন নিজের চেম্বারে। সেখানেও দীর্ঘ রোগীর লাইন। 

তবে হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস রুম কিংবা চেম্বার কোথাও টাকা নিচ্ছেন না। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা -কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের থেকে। তাদের জন্য চিকিৎসা সেবা যত সহজ ও মানসম্মত করা যায় তার কমতি থাকে না তার প্রচেষ্টায়। 

বলছি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োক্যামিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শাকিল মাহমুদের কথা।

স্বার্থপরতার এই যুগে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এমনভাবে চিকিৎসা সেবাকে সহজলভ্য করা এই মানুষটি ২০০৬ সালে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে নিজ ক্যাম্পাসেই লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১০ সালে সিনিয়র লেকচারার পদে উন্নীত হন। 

এরপর ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যয়য়ে ডক্টর অব মেডিসিন ডিগ্রি অর্জন করার জন্য ভর্তি হন  এবং ২০১৬ সালে ডিগ্রি অর্জন শেষে একই বছর পুনরায় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন ও ২০১৯ সালে এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদে উন্নীত হয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। 

পাশাপাশি তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অব ফিলসফি’র (পিএইচডি) ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন করছেন। এছাড়াও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে  ‘বিশুদ্ধ খাদ্য চাই’ নামক সংগঠনের প্রধান হিসেব কাজ করে যাচ্ছেন ।  

তবে চাকরি জীবনের শুরু থেকে এখন অবধি প্রায় ১৪ বছর যাবত নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী- অভিভাবক ও এলাকার অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন তিনি।   

শিক্ষক ডা. শাকিল মাহমুদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শেষ বর্ষের (৭ম সেমিষ্টার) শিক্ষার্থী পবিত্র কুমার শীল বলেন, ‘স্যার একজন মহৎ মানুষ। যখনই তার কাছে যাই তখনি দু-একজন রোগী দেখি। শুধু গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থী বা কর্মী নয়, বাইরের কেও যদি গরিব হয় তবে স্যার তার থেকে কোনো অর্থ নেন না। তার এই মহানুভাবতা আমাকে মুগ্ধ করে।’

ঢাকার ধামরাইয়ের নয়ারহাটে অবস্থিত মেডিসিন পয়েন্টে ডা. শাকিল মাহমুদের চেম্বারে চিকিৎসা নিতে আসা এক অভিভাবক মোছা. রুবিয়া বেগম বলেন, ‘স্যার অনেক ভাল একজন মানুষ। সবসময় তিনি হাসিমুখে রোগীদের সাথে কথা বলেন। কখনো তার চেহারায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠে না। এমনকি তিনি তার ছাত্র ও অভিভাবকদের কাছ থেকে রোগী দেখে কখনো টাকা নেন না। আমরা সবাই যখন মানবতা ফেলে টাকার পিছনে ছুটছি, তখন তিনি আমাদের সকলের কাছে মানবতার একটি আদর্শ, একটি উদাহরণ।’   

কেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেন এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. শাকিল মাহমুদ বলেন, ‘টাকা পয়সা ইনকাম তো হয়েই যায়। সৎভাবে বেঁচে থাকতে খুব বেশি টাকা লাগে না। এই যে মানুষের দোয়া,  আন্তরিকতা এটা আসলে টাকা দিয়ে পাওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা রোগীরা সুস্থ হচ্ছে, সন্তুষ্ট হচ্ছে। এইটা যে কত বড় আত্মতৃপ্তি , কতবড় দোয়া তা আমি নিজেই অনুভব করি। এই যে সম্মান ,আত্মতৃপ্তি এটার আসলে টাকা পয়সার সাথে সম্পর্ক নেই, এইটা একটা আলাদা বিষয়। 

শিক্ষক, ছাত্র থেকে শুরু করে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে, অনেকেই সুস্থ হয় যা আমাকে আনন্দিত করে। এইটা আসলে টাকা দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়। 

এজন্য অনেকেই টাকা দিতে চাইলেও নিই না, দিলেও ফেরত দেই। এটা তো একটা মানবসেবা, ব্যবসা না, তাই টাকার প্রতি এতটা আগ্রহ হয় না। 

টাকা নামক মরিচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হওয়া এই সমাজে ডা. শাকিল মাহমুদের এমন উদার মানসিকতা-মানবতা আর ভালবাসার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

এআই/আরকে