বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের চতুর্থ দিনে পদ্মার নাচন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:০২ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০২০ সোমবার
জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতি ঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বহুমূখী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ৩ থেকে ২৩ জানুয়ারি ২০২০ দ্বিতীয় বারেরমতো ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০’ আয়োজন করেছে। দেশের ৬৪টি জেলা, ৬৪টি উপজেলা এবং জাতীয় পর্যায়ের পাঁচ হাজারের অধিক শিল্পী ও শতাধিক সংগঠনের অংশগ্রহণে ২১ দিনব্যাপী একাডেমির নন্দনমঞ্চে এই শিল্পযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে।
৬ জানুয়ারি উৎসবের ৪র্থ দিন একাডেমির নন্দনমঞ্চে বিকেল ৪টা থেকে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শুরু হয়। পরিবেশনায় ছিলো জামালপুর, সিরজগঞ্জ ও পঞ্চগড় জেলার পরিবেশনা। শুরুতেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। জেলার পরিবেশনার আগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ঢাকার পরিবেশনায় অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী, বরেণ্য শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমামের একক আবৃত্তি, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিল্পীদের পরিবেশনায় সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাফান, শুপ্ত, শুসমী, অমিত, সাফিন ও লিথি, একক সঙ্গীত পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিশু সঙ্গীত দলের শিল্পী শ্রাবন্তী। দ্বীপা খন্দকারের পরিচালনায় ‘আয়রে আমার দামাল ছেলে এবং তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর’ গানের কথায় ২টি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন।
জামালপুর জেলার পরিবেশনার শুরুতে জেলা ব্রান্ডিং জারীগান এবং দেশাত্ববোধক সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী টুটুল মাহমুদ, আশরাফুল হোসাইন, কাওসার আহমেদ, সাকিব হাসান শুভ, মো: সুমন মিয়া, নাজিমা আনছারী, শ্রাবন্তী, শশী ও শ্রেয়া। ‘তারায় করে ঝিকিমিকি’ ঘেটু নাচ এবং ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ দেশাত্ববোধক গানের কথায় সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে জনি, রাসেল, তপু, আকাশ, অন্তরা, রুপন্তী, সোনিয়া, সাথী, বিথী ও সুমী। একক সঙ্গীত জাতীয় পর্যায়ের তারকা শিল্পী টুটুল খান এবং উপজেলা পর্যায়ের শিল্পী সুমি আক্তার পরিবেশন করে লালনগীতি। যন্ত্রে সানাইয়ের সুর তোলেন শিল্পী মো: কবির, সঞ্জীব সেন, মো: বুলবুল ইসলাম, সেলিনা বেগম ও অজন্তা রহমান।
সিরাজগঞ্জ জেলার পরিবেশনায় ‘জেলা ব্রান্ডিং ভিডিও প্রদর্শনী; বিজয় নিশান উড়ছে ঐ এবং নোঙর তোলো তোলো গানের কথায় সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পী ড. জান্নাত আরা হ্যানরী, রাশু, আশিষ, সাইফুল, দুর্জয়, সুইটি, রেনেসাঁ, প্রিয়ন্তী, আশা ও স্বপ্না সাহা। ‘দেখো আলোয় আলোয় আকাশ এবং আলোকের ঐ ঝর্ণা ধারায় গানের কথায় ২টি সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে শিল্পী ড. জান্নাত আরা হ্যানরী, রাশু, লাজ, হুমায়রা, বিধা, জয়া, অনুরাধা, মামুন, ওসমান, সজীব, তালেব ও সাগর, একক সঙ্গীত পরিবেশন করে জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ড. জান্নাত আরা হ্যানরী এবং উপজেলা পর্যায়ে স্বপ্না সাহা এবং যন্ত্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী আজাদ রহমান, লিটন দাস, শাওন ও মানিক।
পঞ্চগড় জেলার পরিবেশনায় তথ্যচিত্র প্রদর্শনী জেলা ব্রান্ডিং, সমবেত সঙ্গীত ‘হামার জেলা পঞ্চগড় ও হামার পানি টলমল এবং সোনার বাংলা গড়তে হলে ’ গানের কথায় শিল্পী নুরনবী জিন্নাহ, মো. মাহবুব, শিহাব, আদনান, মঞ্জু ইসলাম, আব্দুল মান্নান, পলি দত্ত, সাবরিনা, শবনম মীম, রোকসানা আক্তার ও মুক্তা রাণী; সমবেত নৃত্য ‘একটি মুজিবরের থেকে এবং কারার ঐ লৌহ কপাট ’গানের কথায় শিল্পী সুমন, পলাশ, লিটু, আনান, উমর ফারুক, লিপু, জ্যোতি, অহনা, নীড় ও তিলোত্তমা দাস; একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী স্বরনীকা বিশ্বাস এবং উপজেলা পর্যায়ের শিল্পী রোকসান আক্তার এবং যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী রঞ্জিত সরকার, জ্যোতি, রউস ও রুহিনী সিংহ। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চগড় জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক আবু তোয়াবুর রহমান।
একাডেমি প্রাঙ্গণে রাত 8টায় দর্শনীর বিনিমেয়ে অনিুষ্ঠিত হয় কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য পদ্মার নাচন। রেজাউল সলকের নির্দেশনায় এবং রেজাউল সলক ও নছিমন নাট্যগোষ্ঠীর পরিবেশনায় ‘চাঁদ সওদাগড়ের বানিজ্য পালা ও বেহুলার বিয়’ শির্ষক পরিবেশনাটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন পদ্মা ও বেহুলা মো: শেরাবুল ইসলাম, দোহার মো: জাণরুল মন্ডল, গায়িন মো: আলী হোসেন, বাদক মো: আরিফুল, বাদক ও দোয়ার মো: কালু, দোয়ার মো: কামাল, সনেখা মো: তরিকুল ও নাচিয়ে মো. উজ্জ্বল।
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা, মিরপুর ও দৌলতপুর থানার বিভিন্ন গ্রামে পদ্মপুরণের কাহিনী নিয়ে পদ্মার নাচন নামে এক ধরণের পরিবেশনা রীতি প্রচলিত রয়েছে। মূলত নৃত্যপ্রধান গীতিনাট্যাভিনয় এই লোকনাট্যের সাধারণ বিশেষত্ব। পদ্মপুরণের আখ্যানের গীতিনাট্যমূলক পরিবেশনায় নৃত্যের আধিক্য থাকে বলেই পরিবেশনা রীতির নামের সঙ্গে নাচন শ্বদটি যুক্ত হয়েছে। নৃত্য ছাড়াও এধরনের পরিবেশনা রীতিতে বর্ণনাত্বক গীত এবং সংলাপও অভিনয়ে লক্ষ্য করা যায়। মূলত পাবনা অঞ্চলে প্রচলিত পদ্মপুরাণ গান থেকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে সৃষ্টি হয়েছে। কুষ্টিয়ার জেলার গ্রামে বসবাসরত নিম্নবর্ণের হিন্দু-মুসলমান জনতা এধরনের নাট্যপালার পৃষ্ঠপোষক। তারা সাধারণত সন্তান কামনা, বিপদ থেকে উদ্ধার, সাপের ভয়-ভীতি থেকে রক্ষা পাবার লক্ষ্যে পদ্মার নাচন আয়োজন করে থাকেন। আসরের শুরুতে বাদ্যযন্ত্রী ও অন্যান্য কুশীলব খোল বাদককে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে দাড়িয়ে ভূমি প্রণাম করে। এরপর বাদ্যযন্ত্রের তালে নাচের মাধ্যমে বামদিক থেকে ডান দিকে আসর পরিক্রমা করে। পরবর্তীতে পরিবেশনায় একে একে রামস্তব, বন্দনা গীত ও পালার প্রসঙ্গ শেষে মূল আখ্যানে বর্ণনাত্বক গীত, গদ্য ও সংলাপের মাধ্যমে পরিবেশনা চলতে থাকে।
আগামীকাল ৭জানুয়ারি ২০২০বিকেল ৪টা থেকে একাডেমি প্রাঙ্গণ নন্দনমঞ্চে পরিবেশিত হবে রাজবাড়ী, মৌলভীবাজার ও বগুড়া জেলার সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং রাত 8টায় একাডেমি প্রাঙ্গণে দর্শনির মিনিময়ে অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য পরিবেশনা ‘গুণাই বিবির পালা’।
গত ৩ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার বিকেল ৫টায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে উৎসবের উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান; উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মানিত সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন একাডেমির সচিব মো. বদরুল আনম ভূঁইয়া।
বাংলাদেশ হাজার বছরের বর্ণিল ও বিচিত্র সংস্কৃতির অপরূপ লীলাভূমি। হাজার বছরের সেই ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে আজও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে দেশব্যাপী পরিচালিত হচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ। লোকজ সংস্কৃতি আমাদের অন্যতম শক্তি যা বিশ্বব্যাপী আমাদের স্বাতন্ত্রকে জানান দেয়। বাঙালি সংস্কৃতির রূপ, নির্মিত ও পরিবেশনা কৌশল আসলে মিশ্র প্রকৃতির; বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা, ভাষা ও প্রকরণের সমন্বয় ঘটে আমাদের সংস্কৃতি আজকের জায়গায় পৌঁছেছে।
২১ দিনব্যাপী বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের পরিবেশনার মধ্যে রয়েছে সমবেত সংগীত, যন্ত্রসংগীত, ঐতিহ্যবাহী লোকজ খেলা, পালা, একক সংগীত, বাউল সংগীত, ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য, যাত্রা, সমবেত নৃত্য, অ্যাক্রোবেটিক, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা, পুতুল নাট্য, একক আবৃত্তি, শিশুদের পরিবেশনা, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগীত ও নৃত্য, নাটকের কোরিওগ্রাফি, বৃন্দ আবৃত্তি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি সম্প্রদায়ের পরিবেশনা, আঞ্চলিক ও জেলা ব্রান্ডিং বিষয়ক সংগীত ও নৃত্য এবং জেলার ঐতিহ্যবাহী ভিডিও চিত্র প্রদর্শনী।’
আরকে//