পাকিস্তানে হত্যার দায় থেকে রেহাই পাওয়ার মূল্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:৪২ এএম, ৭ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার
বুশরা ইফতিখার নামে ২৮ বছর বয়সী এক গৃহবধুকে এতটাই জোরে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল যে হামলাকারীর ছুরিটি বেঁকে যায়। এরপর ওই হামলাকারী স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যায়। এই হত্যাকাণ্ড এতটাই নির্মম ছিল যে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ শহরের অদূরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে আসা গোয়েন্দারাও চমকে উঠেছিলেন।
বুশরার হত্যাকারী হলেন স্বামী সামি উল্লাহ। এই দম্পতির ঘরে রয়েছে মোট চারটি সন্তান এবং বুশরা ইফতিখার তার মৃত্যুর সময় পঞ্চম সন্তান নিয়ে গর্ভবতী ছিল।
তার স্বামী কেন তাকে হত্যা করেছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়। সামি উল্লাহ আদালতে দাবি করেন যে তিনি মানসিক অবসন্নতায় ভুগছেন এবং ওই ঘটনার কোনও কিছু তার মনে নেই।
বুশরার পরিবার বলছে, সামি উল্লাহর অভিযোগ ছিল যে বুশরা অন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে রূপান্তর হতে চায়। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সামি উল্লাহ একজন হিংস্র মানুষ।
সামির বিরুদ্ধে এর আগেও একজন প্রতিবেশিকে হত্যার চেষ্টা এবং রেস্তোরাঁয় সহিংস বাকবিতণ্ডায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
পুলিশ এখন বিশ্বাস করে যে সামিকে কারাগারে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে সামি উল্লাহ আজ পর্যন্ত উপযুক্ত বিচারের মুখোমুখিও হননি।
বুশরা ইফতিখারের ভাইয়ের মতে, সামি উল্লাহর পরিবার স্থানীয়ভাবে বেশ প্রভাবশালী এবং তার বিরুদ্ধে আগে যেসব মামলা হয়েছিল সেখানে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে তিনি পার পেয়ে যান।
মোহাম্মদ জাকারিয়া বিবিসিকে বলেন, অর্থের বিনিময়ে পুরানো মামলাগুলো ফয়সালা করে তিনি দ্রুত কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন।
পাকিস্তানের আইনে, ভুক্তভোগী বা তাদের পরিবার, হত্যা বা যে কোনও গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত সন্দেহভাজনদের ক্ষমা করার অধিকার রাখে।
তাদের কেবল আদালতে বলতে হয় যে তারা একজন সন্দেহভাজনকে ‘ঈশ্বরের নামে’ ক্ষমা করে দিয়েছেন। বাস্তবে, ভুক্তভোগীদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার মাধ্যমে এই ‘ক্ষমা’ কিনে নেন অভিযুক্তরা।
ক্ষতিগ্রস্ত বা তার পরিবারকে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই অর্থ প্রদান অবৈধ নয় বলে স্বীকার করেছেন, আইন পর্যবেক্ষকরা।
শারীরিকভাবে কাউকে ক্ষতি করার মতো অপরাধগুলো ‘আপোস’ বা ‘ক্ষমা’ করার অনুমতি দিয়ে ১৯৯০ এর দশকে এই ক্ষমা করার বিধান চালু করা হয়। ইসলামী আইন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিধানটি চালু করা হয়েছিল।
এই বিধানের সমর্থকরা বলছেন যে পাকিস্তান ইতিমধ্যে অনেক মামলার চাপের মধ্যে রয়েছে। তাই ক্ষমা করার বিধানটি পাকিস্তানের বিলম্বিত আদালত ব্যবস্থার ওপর চাপ কমাতে এবং সংঘাত ঘনীভূত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে এই ক্ষমা আইন প্রণয়নের আগে, দেশটিতে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ছিল ২৯ শতাংশ। অথচ আইন প্রবর্তনের পর ২০০০ সালে এই দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার নেমে ১২ শতাংশে দাঁড়ায়।
সমালোচকদের দাবি, এই আইন অপরাধীদের বার বার দায়মুক্তির সুযোগ দেবে। এবং এটি ক্ষমতাবানরা এই আইনকে ন্যায়বিচার এড়ানোর সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করবে।
বুশরা ইফতিখারের ভাই বিশ্বাস করেন যে, তার বোনের হত্যাকারীকে আগের কোনও মামলায় শাস্তি দেয়া হয়নি বলেই সে এতটা সহিংস করে উঠেছে।
‘সে অহংকারী হয়ে পড়েছিল। সে ভেবেছিল যে এত অপরাধ করার পরও তার কিছুই হয়নি। এখন সে স্বাধীন এবং আইন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।’
সামি উল্লাহর পরিবার স্বীকার করেছেন যে, সামির বিরুদ্ধে আগের মামলাগুলো সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
তবে তারা জোর দিয়ে বলেছেন, শুধু আইনি প্রক্রিয়া এড়ানোর জন্য তারা এই সমঝোতা করতে রাজি হয়েছেন, সামি উল্লাহ দোষী ছিলেন বলে নয়।
এখন হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সামি উল্লাহ। এবার তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করছেন।
বিগত সরকারের আমলে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অস্টার আওসাফ আলী ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও ক্ষমার বিধানটি বহাল রাখা হয়।
লাহোরে নিজ দফতর থেকে বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তির ক্ষমা করার অধিকার রয়েছে, তবে অপরাধ কেবল একজন ব্যক্তির বিষয় নয়, এর পেছনে সমাজও রয়েছে।’
তার পরিকল্পনা ছিল যে কোনও অপরাধের ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক ন্যূনতম শাস্তি প্রবর্তন করা, যাতে ‘মানুষ জানতে পারে যে অপরাধ থেকে পার পেতে কেউ কোনও মূল্য জুড়ে দিতে পারবে না।’
কয়েকজন আলেম তার এই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানালেও বেশ কয়েকজন ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদের বাঁধায় সেটি আটকে যায়।
এই মুহূর্তে, তার ওই পরিকল্পনাটি নতুন করে উত্থাপন করার সম্ভাবনা খুব কম।
বর্তমান আইন, পুলিশ কর্মকর্তা এবং ফৌজদারি আইনজীবী উভয়ের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আদালত প্রমাণ পায় যে জোরপূর্বক এই মীমাংসা করা হয়েছে। তবে এই ধরণের সমঝোতা বাতিল করে দেয়ার অধিকার আদালতের আছে।
তবে আদালতে মামলার চাপ থাকায় প্রতিটি সমঝোতার ঘটনা ঢালাওভাবে তদন্ত করা যায় না। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক এই বিষয়ে একমত হয়েছেন।
এদিকে, একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসির সংবাদদাতাকে বলেছেন যে, তিনি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে অপরাধীদের সমঝোতায় পৌঁছানোর কয়েকটি নজির পেয়েছেন। যেন ওই অপরাধীরা আবার অপরাধের সুযোগ পান।
পুলিশ একটি অপরাধের ঘটনা তদন্ত করতে তাদের সময় এবং সম্পদ ব্যয় করে ঠিকই কিন্তু আদালতে গেলেই এই মামলাগুলো হঠাৎ করে সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
আবার অনেক সময়, পুলিশ নিজেই এই জাতীয় ‘সমঝোতার’ সুবিধাভোগী হতে পারেন। গত বছরের আগস্টে মধ্য পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে এক ব্যক্তি এটিএম বুথের ক্যাশ মেশিন থেকে একটি ব্যাংক কার্ড চুরি করেন।
চুরি করার সময় ওই ব্যক্তি সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে জিহ্বা বের করে ভেঙচি কাটেন। ওই ফুটেজ পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
তবে সালাহউদ্দিন আইয়ুবিকে পুলিশ গ্রেফতার করার পরপরই তিনি পুলিশি হেফাজতেই মারা যান। যার ফলে মামলাটি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
সালাহউদ্দিন আইয়ুবি নামে ওই ব্যক্তির আরও একটি ভিডিও প্রকাশের পর সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। তিনি শুরুতে পুলিশের কাছে মুক ও বধির হওয়ার ভান করেন।
এরপর একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার হাত পিঠের পিছনে পেঁচিয়ে ধরে রাখে এবং আরেকজন পুলিশ সদস্য জিজ্ঞাসাবাদ করে।
সালাহউদ্দিনের বাবা মুহাম্মদ আফজাল প্রথমে তার ছেলের ন্যায়বিচারের জন্য প্রশাসনকে চাপ দিয়ে আসছিলেন, তার দাবি ছিল যে তার ছেলে মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ছিল।
যাইহোক, এক মাস পরে, তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি ‘ঈশ্বরের নামে’ হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের ক্ষমা করছেন।
এক্ষেত্রে ‘সমঝোতা’ বা ‘আপস’ কোনও টাকার বিনিময়ে হয়নি বরং একটি চুক্তির ভিত্তিতে হয়েছে।
সেই চুক্তিতে বলা হয়েছে যে অভিযু্ক্তরা পরিবারটির গ্রামে একটি নতুন আট কিলোমিটার (পাঁচ মাইল) রাস্তা তৈরি করে দেবে, পাশাপাশি নতুন গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করে দেবে। তবে অর্থের প্রকৃত পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি।
সালাহউদ্দিনের বাবা এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট বলে মনে করা হয়, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় এর মধ্যস্থতা করেছিল স্থানীয় এক কট্টরবাদী আলেম।
তবে যাদের শক্তিশালী সমর্থক নেই অথবা যাদের পেছনে জনসাধারণের কোনও চাপ নেই তারা প্রায়শই মনে করেন যে তাদেরকে যা দেওয়া হচ্ছে তাতে সম্মত হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় নেই।
লাহোরের বাইরের একটি গ্রামে, পুলিশি হেফাজতে মারা যাওয়া আরেক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে বিবিসি সংবাদদাতার দেখা হয়েছিল।
হত্যায় ভুলভাবে অভিযুক্ত হওয়ার পর তাকে আটক করা হয়। পরিবারটির নিরাপত্তার স্বার্থে বিবিসি তাদের নাম প্রকাশ করেনি, তবে তারা বিবিসিকে জানায় যে, অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে তাদেরকে জোর করে অর্থ দেয়া হয়েছিল।
ভিকটিমের ভাই বলেন, আমরা তাদেরকে অন্তরে ক্ষমা করিনি। আমরা কখনই তাদেরকে ক্ষমা করব না, তবে আমরা অসহায় ছিলাম।
তিনি বলেন, যখন তারা ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই শুরু করেন, তখন স্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের দরজায় এসে হাজির হন।
‘তারা বলত, সমঝোতায় আসুন। যদি তা না করেন, তারপরও আপনি কিছুই করতে পারবেন না। হয়ত ছয় মাস বা এক বছরের জন্য তাদের কারাদণ্ড হবে, তার পরে ছাড়া পেয়ে তারা আপনাকে নানাভাবে বিপদে ফেলবে।’
পরিবারটি দরিদ্র এবং তাদেরকে একটি বাড়ি কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া হয়। যেটা অর্জন করতে হয়ত তাদের চিরকাল সংগ্রাম করতে হত।
তারা এই আর্থিক সমঝোতা মেনে নেয়, কিন্তু দর কষাকষি করার সময় নিহতের মা ক্ষেপে যান, তার কাছে মনে হয়, যে এই সমঝোতা তাকে দিয়ে জোর করে করানো হয়েছে।
‘আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, এখন যদি আমরা আমাদের আগের ভাড়া বাসায় থাকতাম, এবং আমার ছেলেটি জীবিত থাকত,’ তিনি বলেন। ‘এখন তারা আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়ে আমাকে একটি বাড়ি তৈরির জন্য অর্থ দিয়েছে, এটি কী ধরণের চুক্তি?’
সূত্র: বিবিসি
একে//