ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয়

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

প্রকাশিত : ১০:৪৯ এএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:৫০ এএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির ইতিহাসের অবিসংবাদিত মহানায়ক, বাঙালির সকল স্বাধিকার অর্জনের কিংবদন্তি, অকুতোভয় মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রয়েছে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় ঐতিহ্যিক পরিচয়। উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তাঁর মাঝে আশৈশব ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনা বোধের উন্মেষও ঘটেছিল। মানুষের সমৃদ্ধ বংশ পরিচয় অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অঙ্গনে ব্যাপক অবদান রাখে।

পবিত্র ইসলামেও বংশ পরিচয়ের মূল্যায়নে শিক্ষণীয় নির্দেশনা লক্ষ করা যায়। যদিও ইসলামে বংশ পরিচয় বিদ্যার উপর নানান চর্চা আমরা দেখতে পাই, প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। এমনকি ইসলামপূর্ব জেহালতের যুগেও বংশ পরিচয় বিদ্যার উল্লেখযোগ্য প্রচলন ছিল। আমরা ইতিহাসে এ বিদ্যার সর্বাপেক্ষা উন্নত গ্রন্থ হিসেবে মুয়াররায বিন সাদুসি রচিত হাযফুম মিন নাসাবিন কোরাইশ ও হিশাম বিন মুহাম্মদ কালবি রচিত জামহারাত আন নাসাব গ্রন্থদ্বয় উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত গ্রন্থটি হিজরি দ্বিতীয় শতকে রচিত হয় এবং এটি তৎকালীন বংশ পরিচয় বিদ্যার আকর গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত; পরবর্তীকালে অন্যান্য ঐতিহাসিক এ সংক্রান্ত গ্রন্থ প্রণয়নে উপরিউক্ত গ্রন্থের ব্যাপক সহযোগিতা নিয়েছেন।

মূলত ইসলাম বংশ পরিচয়ের আভিজাত্যকে গৌণ করে মানুষের যোগ্যতা, বিশ্বাস ও ন্যায়-নীতি-নিষ্ঠাকেই ব্যক্তির মর্যাদার মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। ইসলামের এই সর্বজনীন ও মানবিক বিধান মেনে নিয়েও আমরা বলতে পারি, ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় ও বংশীয় আভিজাত্য অনেক সময় ব্যক্তির রুচিবোধ, স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সহায়ক বা সম্পূরক ভূমিকা পালন করে থাকে। সেজন্যই আমরা বলে থাকি, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়। উচ্চ বংশীয় একজন মানুষ ঐতিহ্যগত ভাবেই সাধারণত উন্নত মানসিকতা ও সমৃদ্ধ রুচিবোধের পরিচয় বহন করে থাকেন; ব্যতিক্রম যা রয়েছে তা এ সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন। তিনি ‘শেখ’ বংশীয় উত্তরাধিকার বহন করে আছেন। ‘শেখ’ কথাটি এসেছে আরবি থেকে, যার সাধারণ অর্থ হচ্ছে, খুবই শক্তিশালী, বিপুল ক্ষমতাধর বা আভিজাত্য সম্পন্ন। এটি সম্মানসূচক এক আরবি অভিধা বা পদবি হিসেবেও পরিচিত। বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাবান শাসকদের পদবি হিসেবেও শেখ-এর ব্যবহার রয়েছে এবং সাধারণভাবে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা মুসলমানদের কারো কারো পদবি হিসেবেও শেখ শব্দের ব্যবহার করা হয়।

উল্লেখ্য, আরব সভ্যতার সাংস্কৃতিক বিকাশ ও প্রভাবে এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রসার ও সম্প্রসারণের ফলে আজ এই পদবি নানা দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সম্মানসূচক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে; যা বর্তমানে মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ল্যাটিন শব্দ ‘সেনেক্স’-এর বাংলা ‘বয়োবৃদ্ধ বা সম্মানিত’-এর আরবি প্রতিশব্দই হচ্ছে ‘শেখ’। তবে বর্তমানে এ পদবিতে যারা পরিচিত ও সংশ্লিষ্ট, তার পেছনে রয়েছে অনবদ্য তাৎপর্যময়তা।

ইসলামের মহান পয়গম্বর ও মানবতার পরম বন্ধু হজরত মোহাম্মদ (সা.) ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে যাঁদের সরাসরি তিনি মুসলিম করেছেন, ইতিহাসে তাঁরা ‘শেখ’ অভিধায় ভূষিত। আমাদের এই প্রাচীন বঙ্গীয় জনপদে যাঁরা ইসলামের শাশ্বত পয়গাম নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই আরব আর পারস্য থেকে ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে এ ভূখণ্ডে আগমন করেন। তাঁদের কেউ ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সাহাবি আর কেউ-বা তাবেয়ি, তৎপরবর্তীকালে আরো যাঁরা আসেন তাঁরা হলেন সুফি, দরবেশ, গাউস, কুতুব, অলি ও বুজুর্গ হিসেবে পরিচিত।

মহামতি শেখ আউয়াল নামে ঠিক এমনি এক দরবেশের আগমন এই বঙ্গে ঘটেছিল, আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু তাঁরই বংশের এক সৌভাগ্যবান অধস্তন বংশধর। খোকা নামের নবজাতক সন্তানের শ্বেত-শুভ্র পোশাক ও শশ্রুমণ্ডিত বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের ধারণকৃত এক ভিডিও দলিলের বরাতে বলা যায়, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধু জন্ম লাভ করেন। আশৈশব যিনি অকুতোভয়, সৎসাহসী, সচ্চরিত্র, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দৃঢ়চেতা, স্বাধীনতাপ্রিয়, নেতৃত্বের গুণাবলীসম্পন্ন, দরিদ্রের প্রতি দয়ালু, মানুষের প্রতি মমত্ববোধসম্পন্ন এবং বাবা-মায়ের কথা ও উপদেশের ফরমাবরদার হিসেবে অনন্য ছিলেন বলে উল্লিখিত দলিলে জানিয়েছেন তাঁরই শ্রদ্ধেয় পিতামাতা।

দরবেশ শেখ আউয়াল ব্যবিলনীয় সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে বিশ্বখ্যাত অলিয়ে কামেল ও সুলতানুল আরেফিন হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (রাহ.)-এর সফর সঙ্গী হয়ে ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে বঙ্গে আগমন করেন। আল্লাহর এ মহান অলি সমুদ্রপথে জাহাজে করে আসেন বলে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি খ্যাত চট্টগ্রামে আস্তানা গেড়েছিলেন। দরবেশ শেখ আউয়াল ছিলেন হজরত বায়েজিদের (রাহ.) ঘনিষ্ঠদের অন্যতম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ আউয়াল দরবেশেরই সপ্তম অধস্তন বংশধর ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বংশীয় ঊর্ধ্বতনদের খ্যাতনামা আরেক ব্যক্তি হলেন শেখ বোরহান উদ্দিন, যিনি দরবেশ শেখ আউয়ালের ছেলে শেখ জহির উদ্দিনের দৌহিত্র ছিলেন আর শেখ বোরহান উদ্দিনের বাবা ছিলেন শেখ জান মাহমুদ ওরফে তেকড়ি শেখ।

বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার গল্প গ্রন্থের বরাতে বলা যায়, অলিকুল শিরোমণি বায়েজিদ বোস্তামি (রাহ.) একদা শেখ আউয়ালকে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন, তিনি যেন মেঘনা পাড়ের এলাকায় গমন করেন এবং তথাকার অধিবাসীদের মাঝে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেন। মুর্শিদের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দরবেশ আউয়াল চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও এলাকায়। সেই সুবাদে দরবেশ শেখ আউয়ালের পরবর্তীকালে তাঁরই সন্তান শেখ জহির উদ্দিনও এই অঞ্চলেই বসবাস করেন।

অতঃপর শেখ জহির উদ্দিনের ছেলে তেকড়ি শেখ সোনারগাঁও এলাকায় অনেকদিন বসবাসের পর এক সময় ব্যবসার উদ্দেশে খুলনার দিকে পাড়ি জমান। আর দাদা ও বাবার আস্তানার দায়িত্ব দিয়ে যান অন্য বিশ্বস্ত লোকদের। তেকড়ি শেখের ছেলে শেখ বোরহান উদ্দিন তাঁর জনৈক বন্ধুর কাছে মধুমতি ও ঘাঘোর নদীদ্বয়ের মাঝখানে গড়ে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামের কথা জানতে পারেন। পরবর্তীতে বন্ধুকে নিয়ে রূপসা নদী অতিক্রম করে তিনি চলে আসেন টুঙ্গিপাড়া, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এক কাজি পরিবারে এবং আজীবনের তরে এখানেই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। আর এভাবেই বিখ্যাত শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন হয় ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে।

শেখ বোরহান উদ্দিনের ছেলে শেখ আকরাম হলেন বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানের দাদা, আর শেখ লুৎফর রহমান হলেন শেখ আব্দুল হামিদের সন্তান। এই বংশ পরম্পরায় একটি ট্র্যাজিক ঘটনা রয়েছে। সেটি হলো, এই শেখ পরিবারের গোড়াপত্তনকারী শেখ দরবেশ আউয়াল পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য মক্কা শরিফে গমন করেছিলেন। হয়ত হজ কার্যও সম্পন্ন করেছিলেন, হজের মৌসুম শেষ হলো, অনেক দিন অতিক্রান্ত হলেও পুণ্যাত্মা দরবেশ আউয়াল একদা যে আরব ভূমি থেকে এদেশে এসেছিলেন, সেখান থেকে আর কোনোদিন তিনি আপনজনদের মাঝে প্রত্যাবর্তন করেননি।

শেখ জহির উদ্দিনসহ পরিবারের অন্য সকলের উপর বয়ে যায় বিষাদের ছায়া; আজ অবধি তা এক অজানা রহস্যই থেকে গেল। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভাষায় আমরা যাঁরা বেঁচে আছি তাঁরা এই দুই ভাইয়ের বংশধর আর দুই ভাই বলতে শেখ আকরাম ও শেখ কুদরত। তাঁদের দুজনের মৃত্যুর দুই এক পুরুষ পর থেকেই শেখ বাড়ির পতন শুরু হয়। পরপর কয়েকটি ঘটনার পরেই শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেলো।

বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য মেনে নিয়েই আমরা বলতে পারি, যদিও শেখ পরিবারের নাম-যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভব হ্রাস পেয়েছিল কিন্তু তাঁর সুমহান ঐতিহ্য ও পরিবারের সমৃদ্ধ ইতিহাস কখনোই বিস্মৃত হয়ে যায়নি; বরং সময়ের বিবর্তনে বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে সেই পরিবার আবারো সুকীর্তির শীর্ষে উপনীত হয়েছে এবং এমন আলোকপ্রভার বিকিরণ করেছে যা আর কখনোই ম্রিয়মান হবে না।