ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

ইসলাম পারস্পরিক সুধারণার নির্দেশ দেয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:০৪ এএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

ইসলাম মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতার চেয়ে সামাজিকতার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। গুরুত্ব দেয় সবার প্রতি মানবিক, উদার  ও বন্ধুসুলভ আচরণের। এসব মহৎ গুণের পাশপাশি প্রতিটি মুসলিমকে যে বিশেষ খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে তা হল অন্যের প্রতি সুধারণা পোষণ করা। যাকে উত্তম ইবাদতের সমতুল্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কারো প্রতি কখনো খারাপ ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। কুরআন ও হাদিসে মানুষের প্রতি খারাপ বা মন্দ ধারণা পোষণকে গোনাহের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা পোষণ করা থেকে দূরে থেকো। কারণ, কোনো কোনো ধারণা পাপ। আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয়ে খোঁজ নিও না, একে অন্যের গীবত করো না’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-১২)।

অযথা কারো প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করে গোনাহগার হওয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। হাদিসে পাকে প্রিয়নবী (সা.) সে উপদেশই আমাদের দিয়েছেন। তিনি বলেন,  ‘তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ, ধারণাভিত্তিক কথাই হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না। পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করো না এবং পরস্পর দুশমনি করো না, বরং তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও হে আল্লাহর বান্দারা!’ (বুখারি শরিফ, হাদিস নম্বর ৪৮৪৯, ৫১৪৩)।

উপরোক্ত হাদিসে মোট তিনটি বিষয়ে আলোচনা এসেছে ১. তোমরা একে অপরের দোষ অনুসন্ধান করো না; ২. তোমরা একে অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না এবং ৩. পরস্পর শত্রুতা ও দুশমনি পোষণ করো না। বরং হে আল্লাহর বান্দারা! মিলেমিশে ভাই ভাই হয়ে থাকো।

বর্তমান সমাজে ধারণা বা অনুমান (কারো প্রতি সন্দেহবশত বিনা প্রমাণে কুধারণা বা খারাপ মনোভাব পোষণ করা) একটি ভয়াল ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাইরাসের কবলে পড়ে একটি পরিবার বা একটি সমাজের পতন হয়! কাউকে সন্দেহ করা ধারণা থেকেই সৃষ্টি হয়। তারপর তা আরো জটিল হয়, বিশ্বাস ভঙ্গ হয়, আস্থা নষ্ট হয়, পরিবারের বন্ধন ও সামাজিক একতা বিনষ্ট হয়। ইসলামে তাই ধারণা বা অনুমাননির্ভর কথা বলা হারাম।

এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের কিছু উদ্ধৃতি : ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হইয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৬)।

‘আর যে বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই, তারা কেবল ধারণা-অনুমানের অনুসরণ করে আর সত্যের মোকাবেলায় ধারণা-অনুমান কোনো কাজে আসবে না’ (সূরা আন-নাজম, আয়াত-২৮)। ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) তৎপর প্রহরী তার কাছেই রয়েছে’ (সূরা ক্বাফ, আয়াত-১৮)। ‘আর তুমি যদি দুনিয়ার বেশির ভাগ লোকের কথা অনুসরণ করো তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে ফেলবে; তারা শুধু ধারণা-অনুমানের অনুসরণ করে আর তারা ধারণা-অনুমান ছাড়া আর কিছুই করছে না’ (সূরা আনআম, আয়াত-১১৬)।

হাদিস শরিফ থেকে এ বিষয়ে কিছু উদ্ধৃতি : হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত, নবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে; নচেৎ চুপ থাকে’ (বুখারি শরিফ : ৬০১৮, ৩৩৩১।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেন, ‘যারা মৌখিক স্বীকৃতির মাধ্যমে ঈমান এনেছ, অথচ এখনো অন্তঃকরণে ঈমান পৌঁছেনি! তোমরা মুসলিমদের নিন্দা করো না, তাদের ছিদ্রান্বেষণ করো না। কেননা, যে ব্যক্তি অপরের দোষ খোঁজে আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আর আল্লাহ যার দোষ তালাশ করেন, তাকে তার নিজস্ব বাসগৃহেই অপদস্থ করেন’ (আবু দাউদ শরিফ : ৪৮৮০)।

সুতরাং মানুষের প্রতি কখনো কোনো খারাপ ধারণা পোষণ নয়, বরং সবার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করে সওয়াব ও কল্যাণের অধিকারী হওয়া জরুরি। সমাজে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পরস্পরের প্রতি সুধারণা পোষণের বিকল্প নেই। অযথা কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণের মাধ্যমে তার চরিত্র হনন থেকে বিরত থাকাও জরুরি। কারণ, এতে রয়েছে মারাত্মক গোনাহ।

মানুষের উচিত হলো, মনের সব বিষয় একমাত্র গায়েবজান্তা আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা। আল্লাহ আমাদের মানুষের অন্তর চিড়ে তার স্বরূপ উদ্ঘাটনের নির্দেশ দেননি।

হযরত উসামাহ বিন জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের হুরাকাহ নামক স্থানে জুহাইনা গোত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য পাঠিয়েছেন। সেখানে আমরা প্রভাতে তাদের ওপর হামলা করি। আমি ও একজন আনসার সাহাবি মিলে তাদের একজনের ওপর আক্রমণ করলাম। আমরা তাকে কাবু করে ফেললে সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। ফলে আনসারি সাহাবি তাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমি আমার বল্লম দ্বারা আঘাত করে তাকে হত্যা করে ফেলি। যখন আমরা ফিরে আসি, তখন এ সংবাদ রাসুল (সা.)-এর কাছে পৌঁছে।

তিনি বলেন, ‘হে উসামা! ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পরও তুমি তাকে হত্যা করলে? আমি বললাম, সে হত্যা থেকে আত্মরক্ষার জন্য কালেমা পড়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) কথাটার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। আর আমি আফসোসের সঙ্গে কামনা করলাম, হায়! আমি যদি এ দিনের আগে ইসলাম গ্রহণ না করতাম (তাহলে তো আমার মাধ্যমে এমন ঘটনা সংঘটিত হতো না)।’

তাই আসুন, আমরা পরস্পরের প্রতি খারাপ ধারণা বা অনুমান নির্ভর কথা না বলি। পারস্পরিক সুধারণা রাখি। তবেই পরিবার ও সমাজের দ্বন্দ্ব-কলহ নিঃশেষ হয়ে সমাজে ভ্রতৃত্ববোধ অটুট হবে। দৃঢ় হবে পরিবার ও সামাজিক মেলবন্ধনের সেতু।

এআই/