শিক্ষা বিস্তারে বঙ্গবন্ধুর অবদান
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:১৫ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০২:০৫ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২০ শনিবার
বাঙালি জাতির ভাগ্য উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি যে সম্ভব নয়, তা অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি একটি শিক্ষিত জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। শোষণমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থা।
স্বাধীনতার পর ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ, সংবিধানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক, শিক্ষা কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করেছেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈষম্যহীন ও যুগোপযোগী করার জন্য কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু।
শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল বঙ্গবন্ধুর। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের সময়েও তিনি কার্যকরী সার্বজনিন শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে জনমুখী ও সম্প্রসারণ করতে কোনো কৃপণতা করেননি। সেই লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন বঙ্গবন্ধু।
শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।’ এছাড়া বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বই, শিক্ষা উপকরণ ও খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন। যথা- প্রথমত, ‘সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ দ্বিতীয়তা, ‘নিরক্ষতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্যে একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।’ তৃতীয়ত, ‘দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নিয়ে ১৯৭০ সালে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা তিনি শুধু ভাষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বাস্তবে রূপদান করেছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার পর। তিনি দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করেন।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি সব জায়গায় আধুনিক ও মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তবে আমূল পরিবর্তনটা তিনি এনেছিলেন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায়। উচ্চশিক্ষাকেও যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এসে দেশে উচ্চশিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং ধনী-গরিব বৈষম্য দূর করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করলেন এবং গঠন করলেন মঞ্জুরি কমিশন।
বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় শিক্ষা সম্পর্কিত যে আইন প্রণয়ন করেছিলেন এবং বাস্তবায়নে চলমান ছিলেন সেগুলো হলো- প্রাথমিক স্কুল অ্যাক্ট ১৯৭৪, ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশন অব বাংলাদেশ- আদেশ ১৯৭৩, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- আদেশ ১৯৭৩, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়- অ্যাক্ট ১৯৭৩, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়- অ্যাক্ট ১৯৭৩, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়- অ্যাক্ট ১৯৭৩, বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান- আদেশ ১৯৭৩।
এ ছাড়াও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদাকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই শিক্ষা কমিশন বেশ কয়েকটি মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করে। যার ভিত্তিতে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে আরও দুটি শিক্ষাবিষয়ক আইন প্রণীত হয়। তা হলো- মাদ্রাসা এডুকেশন অর্ডিন্যান্স ১৯৭২, প্রাইমারী এডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৪।
বঙ্গবন্ধু দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা বিস্তার ও নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের একটি আইন প্রণয়ন করেন।
এই আইন প্রণয়নের পর প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক করে শিক্ষাকে সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া তাঁর আমল থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু হয়। বিতরণ হত শিক্ষা উপকরণ খাতা, কলম, পেন্সিল পর্যন্ত।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকরি সরকারিকরণ, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই ও গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পোষাক প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীন দেশে প্রথম যে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তাতে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৭% বরাদ্দ বেশি রেখেছিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতের গুরুত্ব অনেক বেশি। তিনি জানতেন প্রতিরক্ষা খাত দিয়ে নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়া যাবে না, শুধু শিক্ষা দিয়েই দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করে জাতিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।
পাকিস্তান আমলে যে সকল শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং এই কমিশন যা সুপারিশ করেছিল তা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এজন্য আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছিল। ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুর উচ্চশিক্ষার অবদানকে তিনটি ক্ষেত্রে বিভক্ত করা যায়। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন, বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, একটি কার্যকরী শিক্ষা কমিশন গঠন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এছাড়া ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন প্রণয়ন করেছিলেন। আইনটির মোট ১৫টি ধারা ছিল। ২০১০ সালে যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় তা ’৭২ সালের শিক্ষা কমিশনের আলোকে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালের শুরুতে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষকদের কাছে মতামত চান। সবাই নিজ নিজ মতামত পেশ করেন। এসব মতামতের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্ত্বশাসন, সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী সবাইকে গণতান্ত্রিক মতামত রাখার সুযোগ প্রদান, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের বিষয়টি উঠে আসে।
এসব প্রস্তাব পাওয়ার পর ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দ্রুত আইন জারি করা হয়। আইনগুলো ছিল যথেষ্ট গণতান্ত্রিক ও অংশিদারিত্বমূলক। শিক্ষক-ছাত্রদের দীর্ঘদিনের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে এই আইনগুলোতে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ফলে একটা আমূল পরিবর্তন আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সত্যিকার অর্থে জ্ঞান চর্চার তীর্থভূমি এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেন তাতে তিনি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে শিক্ষার বিষয়টি উল্লেখ আছে। তাতে রয়েছে- ১৭(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষতা দূর করার জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বঙ্গবন্ধু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তার শিক্ষা দর্শন আমাদের মুক্তির পথকে সুগম করেছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো নির্দেশনাতেই একটি সুখি সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে।
এএইচ/