ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

‘পৃথিবীর কুৎসিততম নারী’র সৌন্দর্যমণ্ডিত জয়

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ০৭:৫৪ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:১১ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২০ শনিবার

লিজি ভালসাকেজ- সংগৃহীত

লিজি ভালসাকেজ- সংগৃহীত

‘সৌন্দর্য’ এই শব্দটির কি কোনো সংজ্ঞা হয়? না, হয় না। কোন ব্যাখ্যা দিয়েও হয়ত এর ব্যাপ্তি বোঝানো সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে অসুন্দর বা কুৎসিত শব্দেরও কোন সার্বজনীন সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।

বিষয়গুলো পুরোপুরিই বিমূর্ত, অবস্তুগত। কিন্তু এ বিমূর্ত বা অবস্তুগত বিষয়গুলোর জন্যই আমার পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলি। নিরন্তন পথচলার মাঝে আমরা কোন বিরাম দেই না। আপাতদৃষ্টিতে সৌন্দর্য পাগলরা কি সৌন্দর্যের মানে বের করতে পারছেন? পারেননি। যদি পারতেন তাহলে নর-নারীর প্রেম বা ভালোবাসা এক বিন্দুতেই আটকে থাকত। এক ব্যক্তিতেই এর পুরোদস্তুর প্রয়োগ হতো।

এরপরও এই জগতে সৌন্দর বা অসুন্দরের বিষয়টি আরোপিত করা হয়। সমাজ কাউকে কাউকে সুন্দর বা অসুন্দরের খেতাব দিয়ে থাকে। এই খেতাব প্রদানের সময় ভাবার অবকাশ থাকে না যে, সৌন্দর্য ও অসুন্দরের ব্যাখ্যা সার্বজনীন নয়। আমাদের পৃথিবী এক নারীকে ‘পৃথিবীর কুৎসিততম নারী’র খেতাব দিয়েছিল। বাহ্যিক অবয়ব দেখেই কি অসুন্দর বা কুৎসিত’র খেতাব দেওয়া যায়? তবে এ নারী জগতের দেওয়া এমন সীমাকে অতিক্রম করে হয়ে উঠেছেন অনন্য। জয় করেছেন সৌন্দর্যমন্ডিত খেতাব। 

নাম লিজি ভালসাকেজ। জন্মেছিলেন ১৩ মার্চ ১৯৮৯ তে টেক্সাসের অস্টিনে। এখন তাঁর বয়স ২৭ বছর। দেখতে রীতিমত ভয়ংকর, কুৎসিত, যার একটি চোখ ও অন্ধ! রঙিন সভ্যতা স্বীকৃতি দিয়েছিল  বিশ্বের সবচাইতে কুৎসিৎ মানুষের! তাদের ভাষায় তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিৎ নারী! সর্বনিম্ন ওজন থাকা উচিত ৫৪ কেজি। কিন্তু লিজির ওজন মাত্র ২৯ কেজি। অনেক চেষ্টার পরও নিজের ওজন বৃদ্ধি করতে পারেননি। যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন তার পক্ষে ২৯ কেজির বেশি ওজন বৃদ্ধি করা সম্ভবও হবে না।

পরিবারের সঙ্গে লিজি ভালসাকেজ- সংগৃহীত

সারা পৃথিবীতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র দুজন। লিজি ভালসাকেজ এবং আবি সলোমন নামের আরেকজন নারী। সেবা কিংবা কোনো চিকিৎসায় এই রোগ ভালো হবার নয়। লিজি ভালসাকেজ উচ্চতায় পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। মাতৃগর্ভে প্রায় ৩৮ সপ্তাহ থাকার পরে সাধারণত শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু মায়ের সমস্যার কারণে চার সপ্তাহের প্রি-ম্যাচিওর শিশু হিসেবে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। ওজন ছিল মাত্র ২ পাউন্ড ১১ আউন্স। চিকিৎসকরা জানালেন, লিজি কোনোদিন কথা বলতে পারবে না, হাঁটাচলা করতে পারবে না, এমনকি নিজে নিজে হামাগুড়িও দিতে পারবে না। এমন সতর্কবাণী বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিলেও আশাহত করতে পারেনি।

লিজির সৌন্দর্য ও অবয়ব আমাদের মতো নয়। শীর্ণকায় সম্পূর্ণ মেদবিহীন একজন নারী। এই বাহ্যিক অবয়বের পেছনে রয়েছে বিরল এক রোগ। নাম Marfanoid–progeroid–lipodystrophy syndrome (মারফানয়েড–প্রোজেরয়েড–লিপোডিসট্রফি সিনড্রোম)। জন্ম থেকেই তিনি এ রোগে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্তদের শরীরে মেদ হয় না। অ্যাডিপোজ টিস্যু না থাকার কারণে শরীরে শক্তি সঞ্চিত হয় না, ওজনও বাড়ে না। শরীরে শক্তি সঞ্চিত না হওয়ায় ১৫-২০ মিনিট পরপর একবার করে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। দুটি চোখের একটি পুরোপুরি নষ্ট। জন্ম থেকেই ডান চোখে দেখতে পান না। মারফান সিন্ড্রোমের প্রকোপে অপর চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ। তবে এ রোগ তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মস্তিষ্ক ও অস্থির গঠনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

অবহেলা ও ঘুরে দাঁড়ানো
বাহ্যিক অবয়বের জন্য তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড বুলিং বা টিটকারির শিকার হয়েছিলেন। আশেপাশের মানুষদের থেকেই নয়, মারাত্মকভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকারও হয়েছেন। প্রায় প্রতিটি মানুষই বুলিংয়ের তিক্ততার মুখামুখি হয়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এটি ছিল মাত্রাতিরিক্ত। 

১৭ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে নিয়ে আলোচনার মতো কিছুই ঘটেনি। তখন ২০০৬ সাল। হাইস্কুলে পড়ার সময় তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল আট মিনিটের ইউটিউব ভিডিও। যুগের সভ্যতা তাঁর নাম দিয়েছিল বিশ্বের কুৎসিত মেয়ে বা আগলিয়েস্ট গার্ল। ভিডিওটি ব্রডকাস্ট হওয়ার পর অনেকে তাঁকে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিল। নিচে হাজার হাজার কমেন্ট। মানুষ কমেন্টে বলছে “Lizzie, please, please just do the world of favor, put a gun to your head and kill yourself.”

লিজি ভালসাকেজ’র ৩য় বই ‘ডেয়ার টু বি কাইন্ড’- আমাজন

লক্ষ্য স্থির
সবাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন- আত্মহত্যা করতে, সবার থেকে লুকিয়ে থাকতে, মুখ ঢেকে রাখতে। কিন্তু সেইসব কিছু কানে না নিয়ে তখনই নিজের জীবনের চারটি লক্ষ্য স্থির করে ফেলেছিলেন লিজি।

লক্ষ্য গুলো হলো-

১) একজন সুবক্তা হওয়া;
২) নিজের লেখা বই প্রকাশ করা;
৩) স্নাতক হওয়া ও নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করা এবং
৪) পরিবার তৈরি করা।

সেই লক্ষ্যকে পুঁজি করেই গত সাত বছরে দু’শোরও বেশি ওয়ার্কশপে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। কীভাবে অভিনবত্বকে স্বীকৃতি দিতে হয়, বিঘ্ন পেরিয়ে কীভাবে জীবনকে গ্রহণ করতে হয়, আত্মবিশ্বাস অর্জন ও নিজেকে ভালোবাসতে হয়, এই সাত বছর ধরে সেই বিষয়ের ওপরই মোটিভেশনাল বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন লিজি। মানুষ প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তাঁর আত্মবিশ্বাস অনুধাবন করে।

এখন পর্যন্ত চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি বই যৌথভাবে লেখা। বাকি তিনটি এককভাবে নিজের লেখা। ২০১০ সালে দৃষ্টিনন্দিত প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘লিজি বিউটিফুল’। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বই ‘বি বিউটিফুল, বি ইউ’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় বই ডেয়ার টু বি কাইন্ড। এখানে তিনি আলোচনা করেছেন অসহিষ্ণুতাকে অবলম্বন করে সমাজ থেকে বুলিং কীভাবে মুছে ফেলা যায় সে বিষয়ে।

২০১২ সালে আমেরিকার টেক্সাস স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমিউনিকেশন স্টাডিজে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। জনসচেতনতা, এন্টি-বুলিং, মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ইত্যাদি নিয়ে তিনি প্রেরণা উদ্দীপক বক্তব্য দিয়ে থাকেন। ২০১৪ সালে ‘টেডটক’ সংগঠনের আহবানে বক্তৃতা দিয়েছেন যার শিরোনাম ছিল ‘হাউ ডু ইউ ডিভাইন ইওরসেলফ’। ভেরিফাইড নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল আছে, যার সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা এ মুহূর্তে আট লক্ষের কাছাকাছি।

তার সেরা কিছু উক্তি
তার প্রত্যেকটি বই ও বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে প্রেরণা দেয়া। তার কিছু প্রেরণাদায়ক উক্তি এখানে তুলে ধরা হলো।

‘‘আপনি যেমন, ঠিক তেমনটা হওয়াই সুন্দর। সবার মতো না হওয়াটাই ভালো। যে বিষয়টা আপনাকে অনন্য করে তোলে, সেটাই আপনাকে আসলে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। কারণ, সে বিষয়টাই মূলত আপনাকে ‘আপনি’ বানিয়েছে। আপনি যেমন, ঠিক সেভাবেই আপনাকে এই বিশ্বের খুব প্রয়োজন। এটাই সত্য; খুব সহজ এবং সাধারণ কথা।’’

‘‘আমি সবসময় বলে থাকি যে, বিশ্বে ইতিবাচক পরিবর্তনটা কিন্তু একজনকে দিয়েই শুরু হয়। সেই ব্যক্তিটি আপনিও হতে পারেন। তাই নিজেকে ঠিক নিজের প্রতিচ্ছবির মতো গড়ে তোলাটা শিখতে হবে। এই বিশ্বকে পরিচর্যা করার শক্তি ও ইচ্ছা শক্তি অর্জন করতে চাইলে নিজেদের পরিচর্যা কীভাবে করতে হয় সে শিল্পটা আগে আয়ত্ব করতে হবে।’’

বাবা-মায়ের কোলে ছোট্ট লিজি- সংগৃহীত

‘‘সত্যিকারের সৌন্দর্য হলো নিজের স্বাতন্ত্র্য আবিষ্কার করা এবং স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত হওয়া।’’

‘‘আমার কাছে চূড়ান্ত সুখ মানে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, যেখানে গিয়ে আপনার চলার পথ ফুরিয়ে যাবে। আমার কাছে চূড়ান্ত সুখ মানে একটি লম্বা সফর, নিজেকে সুখী রাখতে যার প্রতিটি দিনকেই বেছে নিতে হবে।’’

‘‘শুধুমাত্র নিজের মতো হওয়াই সফলতার জন্য যথেষ্ট।’’

‘‘যে সময়টি আপনি অতিবাহিত করছেন তা সবচেয়ে সেরা হবে, না সবচেয়ে খারাপ হবে- সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আপনার হাতেই।’’

তিনি আজ নন্দিত। নিন্দাকে তিনি পাশ কাটিয়ে উঠে এসেছেন। সম্পাদন করেছেন সৌন্দর্যমন্ডিত কর্মকান্ড। তার এক বন্ধু লিখেছেন, ‘লিজি কুৎসিত নয়। কুৎসিত হল লিজিকে দেখার আমাদের চোখ।’ লিজির মা বলছেন, ‘আমি লিজিকে ভালোবাসি। আমি তার মা এটা আমার গর্বের বিষয়।’

আসলেই লিজি সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিখিয়েছেন, সমাজ কোন কিছুকে ইচ্ছে মতো নির্মাণ করে দিলেই তা মেনে নিতে হবে তা নয়। তবে এটা সত্য লিজি কিছু করতে না পারলে পৃথিবী তাকে অসুন্দর হিসেবেই প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেত। সমাজে তথা পৃথিবীতে লিজির বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব হতো। লিজি আজ অনেকের জন্যই প্রেরণা। পুরো সমাজের জন্য এক প্রেরণার নাম।

এমএস/এসি