ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪৬ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০২০ সোমবার | আপডেট: ০৯:২০ এএম, ২১ জানুয়ারি ২০২০ মঙ্গলবার

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন বিচক্ষণ নেতা। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে কখনই ভুল করতেন না। যখন সিদ্ধান্ত নিতেন ভেবে-চিন্তে নিতেন। একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ফাঁসির মঞ্চে যেতে রাজি থাকতেন, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তকে তিনি পরিবর্তন করতেন না।

বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, তথা বাংলার প্রাণপুরুষ  ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সারাজীবন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন তিনি। নিজের জীবন বাজি রেখে ফাঁসির কাষ্ঠের সামনে গিয়েও তিনি মাথানত করেননি। তাই তো তিনি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর ডাকে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ এক কাতারে এসে হাজির হতো।

তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী এই পূর্ববঙ্গে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষাকে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে দিচ্ছে। তাই ভাষাসংগ্রামকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামে পরিচিত। 

এরপর ’৪৯-এর ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মহান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সমগ্র জাতিকে তিনি জাতীয় মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু কোনোদিন মাথা নত করেননি। একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বুঝতে পেরেছিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে উদ্ধার পেতে হলে স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই।

’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস-সাইক্লোনে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন সেই দুর্গত অঞ্চলে, দাঁড়িয়েছিলেন দুর্গত মানুষের পাশে। সেখান থেকে ফিরে এসে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। আর এভাবে আমরা মরতে চাই না। আমরা আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে মৃত্যুবরণ করতে চাই।’

’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলো। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হলেন। ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করা হলো এবং বঙ্গবন্ধুই একমাত্র রাজনীতিক যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। কোনোদিন পূর্ব পাকিস্তান নাম উচ্চারণ করেননি। সবসময় বলেছেন ‘পূর্ব বাংলা।’ পাকিস্তান গণপরিষদে ‘পূর্ব বাংলা’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেন। 

আইয়ুব খান ’৫৮-এর ৮ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি করে ১২ অক্টোবর ১৩টি মামলার আসামি করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। কারণ, একটি কণ্ঠ যখন উচ্চারিত হতো তখন ওই কণ্ঠে কোটি কোটি বাঙালির কণ্ঠ উচ্চারিত হতো। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সবসময় চেয়েছে সেই কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে। কিন্তু সেই কণ্ঠকে কেউ স্তব্ধ করতে পারেনি। 

’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাজনৈতিক কনভেনশনে বিষয় নির্ধারণী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু জাতির সামনে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। কিন্তু সর্বদলীয় কনভেনশন বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব আমলেই নেয়নি। তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ ছয় দফা পেশ করেন এবং ২০ ফেব্রুয়ারি জনাব আবদুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত দলীয় সভায় ছয় দফা অনুমোদন করান।

বিচক্ষণ নেতা ছিলেন বলেই সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলেননি বঙ্গবন্ধু। বলেছেন, বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ে সংগ্রামের কথা। ১৯৬৬-এর ১৮, ১৯, ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে সারা দেশ সফর করে ৩৫ দিনে মোট ৩৩টি জনসভায় বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু। চট্টগ্রাম গিয়ে বিপ্লবী সূর্যসেনকে স্মরণ করে বীর চট্টলাবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন— ‘এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলের বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ে সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ 

নীতির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন। মাথা নিচু করে কথা বলা তিনি জানতেন না। ’৭০-এর নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর দল যখন স্লোগান দেয় ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ যখন বঙ্গবন্ধুকে বলা হয়েছিল, ‘এলএফও’র (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) অধীনে নির্বাচন করে আপনার কোনো লাভ হবে না।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন— ‘এলএফও, ইমিডিয়েটলি আফটার দি ইলেকশন আই উইল টিয়ার দিস এলএফও ইন টু পিসেস।’ অর্থাৎ নির্বাচনের পর এ এলএফও আমি টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলব। এলএফওর ২৫ ও ২৭ অনুচ্ছেদে ছিল— সংবিধান প্রণীত হলেও এটি অথেনটিকেট করবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। 

নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন— ‘ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, কে এই দেশের নেতা বিশ্ববাসীর কাছে সেটি তুলে ধরার জন্যই আমি নির্বাচন করছি।’ বাংলার মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেছিলেন তিনিই এ দেশের একক নেতা। 

পরবর্তীতে তার একক নেতৃত্বেই ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর দুই লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে জোরদার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন বাংলাদেশের পক্ষে। পানি বণ্টনের এ উদ্যোগের ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে পাম্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার।

বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতায় স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আইএমএফ, আইএলও, আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়ন, ইউনেস্কো, কলম্বো প্ল্যান ও গ্যাটের সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয়। একই বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে আবেদন পাঠান। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম স্বাধীন দেশ হিসেবে সদস্যপদ পেয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বদা একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী ও অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, যে দেশে ধনী-গরিব সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা সোনার বাংলা তৈরি করবে। সেই লক্ষ্যেই আজ বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে।

তথ্যসূত্র : আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদের বিভিন্ন লেখা।

এএইচ/