লিভারপুলকে যেভাবে শীর্ষে তুললেন ক্লপ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৫১ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২০ সোমবার
ত্রিশ বছর ধরে কোনও লিগ শিরোপা জেতেনি লিভারপুল। অথচ, সেই লিভারপুল এখন অপেক্ষা করছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা কবে নিশ্চিত করবে? ২৯ ফেব্রুয়ারি নাকি ১৪ মার্চ?
এভারটনের বিপক্ষে মার্সিসাইডের ডার্বি ১৪ মার্চ, ম্যাচটাও এভারটনের মাঠ গুডিসন পার্কে। এখানেই গত মৌসুমে একটি গোলশূন্য ড্র লিভারপুলের শিরোপার আশা কার্যত শেষ করে দিয়েছিল।
সেবার টানা নয়টি ম্যাচ জিতেও পেপ গার্দিওলার অধীনস্ত ম্যানচেস্টার সিটিকে ধরতে পারেনি লিভারপুল।
এখন শক্তিমত্তার দিক থেকে লিভারপুলের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ম্যানচেস্টার সিটিই। যদি দুই দলই সামনের সবগুলো ম্যাচ জিতে যায়, সেক্ষেত্রে এতিহাদে ৪ এপ্রিল ম্যানচেস্টার সিটিই থাকবে লিভারপুলের প্রতিদ্বন্দ্বী, যেটি হয়ে দাঁড়াতে পারে লিগের অলিখিত ফাইনালে। সেক্ষেত্রে সিটিকে হারিয়ে শিরোপা জেতাটাও কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপের জন্য।
রোববার রাতে নিজেদের মাঠে লিভারপুল যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারায়, তখন গ্যালারি থেকে শ্লোগান আসছিল, আমরা লিগ জিততে যাচ্ছি। অবশ্য ক্লপ বলছেন, এখনই উদযাপন নয়।
এখন পর্যন্ত লিভারপুল যে গতিতে এগোচ্ছে, সেই গতি অব্যহত থাকলে একদা গড়পরতা এই ক্লাবটি এবার প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসের দ্রুততম লিগ নিশ্চিত করা ক্লাব হতে যাচ্ছে।
ক্লাবটি যদি ১৪ এপ্রিলের আগে জয় পায় তাহলে সেটা হবে দ্রুততম জয়। রেকর্ডটি এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ও ম্যানচেস্টার সিটির। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ২০০১ সালে ও সিটি ২০১৮ সালে পাঁচ ম্যাচ হাতে রেখে শিরোপা নিশ্চিত করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রেকর্ড ভাঙ্গা তো সময়ের ব্যাপার, কিন্তু স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে যে উদাহরণ দাঁড় করিয়েছে সেটা কি ক্লপের লিভারপুল পারবে?
স্যার অ্যালেক্স মোট ২১ টি প্রিমিয়ার লিগ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সামাল দিয়েছেন, যার মধ্যে ১৩টিতে চ্যাম্পিয়ন ক্লাবটি।
এছাড়া ১৯৯৯ থেকে ২০০১ এবং ২০০৭ থেকে ২০০৯, দু দফায় হ্যাট্রিক শিরোপা জেতে ইউনাইটেড।
এরপর এফএ কাপ, ইউরোপা কাপ ও ইএফএল কাপ জিতলেও ২০১৩ সাল থেকে আজকের তারিখ পর্যন্ত প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেরা সাফল্য দ্বিতীয় অবস্থানে আসা।
এখন লিভারপুল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়ে ৩০ পয়েন্ট এগিয়ে আছে। ক্লাব বিশ্বকাপ শিরোপা জেতা যে কোনও দলকে তাত্ত্বিকভাবে বিশ্বসেরা দল বলা যায়, দলটা যদি ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নও হয় সেক্ষেত্রে তাৎপর্য আরও বেড়ে যায়। এই মুহূর্তে এমন ক্লাব হলো লিভারপুল।
গত দশকেরও মাঝামাঝি অবস্থায় ক্লাবটি ইউরোপের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিয়মিত ছিল না।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যে ক্লাব মাত্র একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলে সেই ক্লাবটি এখন ইউরোপ সেরা তো বটেই বিশ্বসেরাও।
মো. সালাহ, সাদিও মানে, ফন ডাইকরা তো মাঠে আছেনই। তাদের সঠিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ।
যদিও ইউরোপে লিভারপুল ছিল ভিন্ন মেজাজে তবুও এই ক্লাবটির ইংল্যান্ডে সেরা চারে থাকা ছাড়া তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি বহু বছর।
২০০৪-০৫ মৌসুমে তুরস্কের ইস্তানবুলে এসি মিলানের সঙ্গে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালকে ফুটবল বিশারদরা বলে থাকেন রুপকথার এক রাত।
কিন্তু সেই এক রাত ছাড়া প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছরে লিভারপুল ক্লাব হিসেবে ইংল্যান্ড বা ইউরোপে বড় শিরোপা জেতেনি।
২০০১ ও ২০০৬ সালে এফএ কাপ যদি হিসেবে না রাখা হয় তাহলে লিভারপুলের বড় সাফল্য সেই একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ২০০৯-১০ মৌসুম থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও অনিয়মিত হয়ে যায় ক্লাবটি। স্টিভেন জেরার্ড দল ছাড়েন, কোচের অদলবদল হয়, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ধরা দেয় না।
ইয়ুর্গেন ক্লপ লিভারপুলের দায়িত্ব নেন ব্র্যান্ডন রজার্সের বদলে ২০১৫ সালে। ৩ বছরের চুক্তি ছিল তখন যেটা বাড়তে বাড়তে ২০২৪ সাল অব্দি ঠেকেছে। অলরেডদের হয়ে ক্লপ তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে ‘নরমাল ওয়ান’ ঘোষণা দেন। জোসে মরিনিয়োর ‘স্পেশাল ওয়ান’ তকমার বিপরীতেই অনেকটা।
টটেনহ্যাম হটস্পারের সঙ্গে ০-০ ড্র দিয়ে ক্লপ আমল শুরু করে লিভারপুল। সেই মৌসুমে লিভারপুল হয় আট নম্বর দল। ইউরোপা লিগের ফাইনালে হারে সেভিয়ার সঙ্গে।
এরপরের মৌসুমেই লিভারপুলের এই অগ্রযাত্রার শুরু এবং সেটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে জায়গা নিশ্চিত করে।
প্রথমে ক্লপ লিভারপুলের রক্ষণভাগের দিকে তাকান। অ্যান্ড্রু রবার্টসন এবং ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আরনল্ড- নিয়মিত মাঠে নামা শুরু করেন লিভারপুলের ফুলব্যাক হিসেবে। একদম রক্ষণের মাঝখানে দাঁড়ান ফন ডাইক এবং লভরেন।
সেবারই ফন ডাইক দেখানো শুরু করেন কিভাবে একজন ডিফেন্ডার পুরো খেলার গতি ও কৌশল নির্ণয় করে দেন।
শক্তিশালী ব্লক, দ্রুত গতির ওঠা নামা, প্রতিপক্ষের বক্সে ত্রাস হয়ে দাঁড়ানো এবং কাউন্টারের জন্য লম্বা পাস- এসব দক্ষতার পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ফন ডাইক একাই হয়ে যান লিভারপুলের তুরুপের তাস।
তার সঙ্গী রবার্টসন এবং আরনল্ড দ্রুতই বিশ্বের অন্যতম সেরা উইং ব্যাকে পরিণত হন। এই মুহূর্তে ফুটবল বাজারের মূল্য বিচারে তিনজন ডিফেন্ডারই ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের ওপরে বা কাছাকাছি।
সেই মৌসুমে লিভারপুল রিয়াল মাদ্রিদের কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ৩-১ গোলে হেরে যায়। ক্লপ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান, কারণ এটা ছিল ক্লপের ম্যানেজার ক্যারিয়ারে সাত ফাইনালের মধ্যে ষষ্ঠ পরাজয়।
আক্রমণে যতটা ক্লপের লিভারপুল ক্ষুরধার ছিল গোল ঠেকাতে ঠিক ততটা হয়ে ওঠেনি তখনও। তখন তারা নিয়ে আসেন ব্রাজিলের নম্বর ওয়ান আলিসন বেকারকে।
টুকটাক ভুল সিদ্ধান্ত ও কিছু অস্বাভাবিক ভুল ছাড়া আলিসন এখন বিশ্বেরই অন্যতম সেরা গোলরক্ষক। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে মো. সালাহ’র গোলেও এসিস্ট করেন আলিসন।
ক্লপের লিভারপুল ২০১৮-১৯ মৌসুমে ঘরোয়া কাপ প্রতিযোগিতায় বেশ দ্রুতই বাদ পড়ে যায়। চেলসির সঙ্গে লিগ কাপে পরাজয় এবং ওলভারহ্যাম্পটনের সঙ্গে এফএ কাপ পরাজয়ের পর নির্ভার লিভারপুল শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে মনোযোগ দেয়। এরপর প্রিমিয়ার লিগে দ্বিতীয় এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শিরোপা জেতে লিভারপুল।
একক কোনও নৈপুণ্য নয়, মানে-সালাহ-ফিরমিনোর ফরোয়ার্ড। হেন্ডারসনের মাঝমাঠ, ফন ডাইক ও দুই উইং ব্যাকের ডিফেন্স লাইন লিভারপুলকে এক অজেয় দল হিসেবে দাঁড় করায়।
যারা এক বছর ধরে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হারেনি, গত ৬৭৫ মিনিটে প্রিমিয়ার লিগে কোনও গোল হজম করেনি।
এমনকি এই লিভারপুল জোসে মরিনিয়োর চাকরিতেও প্রভাব ফেলেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে লিভারপুলের বিপক্ষে হারের পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচের চাকরি হারান মরিনিয়ো।
প্রিমিয়ার লিগে দুই দশক দাপট দেখায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ৯০ এর দশক ও একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। এর আগে সত্তর ও আশির দশকে লিভারপুল এমন দাপট দেখিয়েছিল। সেটা ফিরে আসবে কি আসবে না সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।
উল্লেখ্য, ক্লপের বুন্দেসলিগা আমলে বায়ার্ন মিউনিখ পেয়েছিল যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের কোচ ছিলেন সাত বছর, এই সাত বছর শুধু জার্মানিতেই না ইউরোপেও ডর্টমুন্ড ছিল দুর্দান্ত একটি দল। ২ ম্যাচ বাকি থাকতে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ২০১১ সালে জার্মানির সর্বোচ্চ লিগ শিরোপা জেতে। ২০১১১-১২ মৌসুমে বুন্দেসলিগা ও জার্মানির লিগ কাপ জিতে নিয়ে, ডাবল জয় নিশ্চিত করে ক্লপের বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সেবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ওঠে জার্মানির দুই ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ ও বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, বায়ার্ন ২-১ গোলের জয় পায় আরিয়েন রোবেনের শেষ মুহূর্তের এক গোলে।
সূত্র: বিবিসি
একে//