শিল্প সম্প্রসারণে বঙ্গবন্ধুর অবদান
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:২৩ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২০ বুধবার
দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে শিল্প-কারখানার যে বিকল্প নেই তা বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন। তাই তো তিনি শিল্প-কারখানা সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। জোর দিয়েছিলেন দেশের সর্বত্র ছোট-বড় শিল্প গড়ে তোলার।
চা শিল্পকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ চা বোর্ডের তৃতীয় চেয়ারম্যান হিসেবে ০৪ জুন ১৯৫৭ তারিখ হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ তারিখ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ১১১, ১১২ ও ১১৩ এই ৩টি প্লট নিয়ে চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন।
স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত চা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্বাসিত করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ হতে ১৯৭৪ সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকার চা শিল্পকে সুদৃঢ় অবস্থানে আনয়নের লক্ষ্যে নগদ ভর্তুকি প্রদান করেন ও ভতুর্কি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। তিনি বিধ্বস্ত চা কারখানাগুলোর উন্নয়নে ভারতের অর্থ সহায়তায় ৩০ লাখ রুপির চা যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বঙ্গবন্ধু চা বাগান মালিকদেরকে ১০০ বিঘা পর্যন্ত মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি দেন।
এদেশের চা চাষের উন্নয়নে চা গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতেন গবেষণা ছাড়া চায়ের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি আসামের টোকলাই চা গবেষণা কেন্দ্রের আদলে বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে রুপান্তরিত করেন। তাঁর এ দূরদর্শী সিদ্ধান্তে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট আজ দেশের অন্যান্য জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউটের ন্যায় একটি অন্যতম জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট।
এছাড়া চা শ্রমিকদের জন্যও বঙ্গবন্ধু অবদান রেখেছেন। চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার এবং নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করেন। চা শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ রেশন ব্যবস্থা চালু করেন। চা শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া সমাধানে চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন। শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষার আলো পৌঁছাতে বাগানে বাগানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নেন। সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নের নির্দেশনা প্রদান করেন
বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল কৃষিকে প্রাধান্য দেয়া। বিশেষ করে শিল্প ভিত্তিক কৃষি। পাকিস্তানি শাসন আমলে এ দেশে বিশেষত দেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্পের কোন প্রসার ছিল না। একমাত্র চিনি শিল্পই এখানকার সম্পদ, যার বেশির ভাগই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। তাই দেশ গড়ার দিকে নজর দিয়ে তিনি চিনি শিল্পকে নতুন করে সাজানোর জন্য জোর দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ইক্ষু গবেষণা পরীক্ষাগার। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে পুনর্গঠিত করে ১৯৭৩ সালে তিনি ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেন। কারণ তিনি জানতেন গবেষণা ছাড়া কোন ফসলের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বিদেশ থেকে জাত কিংবা প্রযুক্তি এনে দেশের কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়।
গবেষণার পাশাপাশি ইক্ষু চাষ বাড়ানোর এবং চিনি শিল্পের উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু ‘নিবিড় ইক্ষু উন্নয়ন প্রকল্প’ ও ‘খামার আধুনিকীকরণ প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নতুন চিনিকল স্থাপন ও বিদ্যমান কয়েকটি চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন। চিনির পাশাপাশি গুড় শিল্পের উন্নয়নেও তার ছিল যথেষ্ট সদিচ্ছা।
আজকের বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পের যে বলিষ্ঠ অবস্থান, এর পেছনে বঙ্গবন্ধুর বিশাল অবদান। বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে বিভিন্ন সেক্টরে বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তখন ওষুধ সেক্টরের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। দেশের চাহিদার ৮০% এরও বেশি ওষুধ অত্যন্ত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করতে হতো। দেশে যে সামান্য উৎপাদন হতো তারও সিংহভাগ ছিল বিদেশী কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশের কয়েকজন প্রখ্যাত চিকিৎসককে নিয়ে ১৯৭৩ সালে একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে নীতিমালা প্রণয়ন ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ওষুধ বাছাই, মান যাচাই, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়। এর মাধ্যমে অনেক ওষুধের আমদানি নিষিদ্ধ এবং অনেকগুলোর আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাস্তব অর্থে বাংলাদেশে এটিই ছিল প্রথম একটি ‘ছায়া ওষুধনীতি’, পূর্ণাঙ্গ না হলেও যা ছিল তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য।
এর ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ওষুধ আমদানি খাতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় বন্ধ হয়, জনগণ অপ্রয়োজনীয় ওষুধের পেছনে কষ্টার্জিত পয়সা খরচ না করে জীবন রক্ষাকারী ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের পেছনে তা খরচ করতে সক্ষম হয় এবং গরিব জনগণের জন্য সাশ্রয়ী খরচে চিকিৎসা সেবা প্রদান চালু করা সম্ভব হয়।
বঙ্গবন্ধু জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির পেটেন্টকৃত ওষুধও দেশীয় কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদনের জন্য গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পেটেন্ট আইনের বাইরে রাখেন। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বিপুল প্রণোদনা লাভ করে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারের কারণে জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলোর দাম কমে আসার পাশাপাশি এগুলো সহজলভ্য হয়। এবং দেশের অর্থনীতিতেও তা অবদান রাখতে শুরু করে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সুদূর প্রসারি চিন্তার প্রতিফলন হিসাবে ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-১৪৩ বলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি কক্সবাজারের সৌন্দর্যমণ্ডিত ঝাউ গাছের সূচনা করেছিলেন। যা দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছিল।
এছাড়া পাট শিল্প, কুটির শিল্প, বস্ত্র শিল্প বিকাশে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
এএইচ/