ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

ক্ষুদ্র কৃষকের স্বার্থে সমবায় ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেন বঙ্গবন্ধু

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০২:১৬ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২০ বৃহস্পতিবার

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃীত

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃীত

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন, সত্যিকারের স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হবে যখন অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে, আপামর জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়ন হবে। তাই তিনি ক্ষুদ্র কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমবায় ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছিলেন। কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, জেলে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়েছিলেন ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের হাত থেকে।

১৯৭২ সালের ৩ জুন সমবায় সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো: 

আমার দেশের প্রতি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ- সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরীব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন-যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের সুসম বণ্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্র চাষী গণতান্ত্রিক অংশ ও অধিকার পাবে।

জোতদার ধনী চাষীর শোষণ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবে সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একইভাবে কৃষক, শ্রমিক, তাঁতী, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উৎপাদনের মাধ্যমে একত্র করতে পারেন তবে আর মধ্যবর্তী ধনিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতির গোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না। 

সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত দুঃখী মানুষ। সমাজতন্ত্র স্থাপনের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই সমস্ত বড় শিল্প, ব্যাংক, পাটকল, চিনিকল, সূতাকল ইত্যাদি জাতীয়করণ করেছি। জমির সর্বোচ্চ মালিকানার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছি। 

আজ সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামে গ্রামে, থানায়, বন্দরে গড়ে তুলতে হবে মেহনতী মানুষের যৌথ মালিকানা। কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল- ভোগের ন্যায্য অধিকার। কিন্তু এই লক্ষ্যে যদি আমাদের পৌঁছাতে হয় তবে অতীতের ঘুনেধরা সমবায় ব্যবস্থাকে আমুল পরিবর্তন করে এক সত্যিকারের গণমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অতীতের সমবায় ছিল শোষক- গোষ্ঠীর ক্রীড়নক। তাই সেখানে ছিল কোটারী স্বার্থের ব্যাপক ভূমিকা।

আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে ঐ ধরনের ভূঁয়া সমবায় কোন মতেই সহ্য করা হবে না। আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী জনতার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান।

আপনারা জানেন, সমবায় সংস্থাগুলিকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে আমি ঘোষণা করেছি যে, সংস্থার পরিচালনা-দায়িত্ব ন্যস্ত থাকবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর, কোন আমলা বা মনোনীত ব্যক্তির উপরে নয়। আমার সমবায়ী ভাইয়েরা এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপকে অভিনন্দিত করেছেন। এই গণতন্ত্রীকরণের পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই তাদের দায়িত্ব। 

তাদের দেখতে হবে যে, সমবায় সংস্থাগুলি যেন সত্যিকারের জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠে। জেলে সমিতি, তাঁতী সমিতি, গ্রামীণ কৃষক সমিতি যেন সত্যিকারের জেলে, তাঁতী, কৃষকের সংস্থা হয়, মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী বা ধনী কৃষক যেন আবার এই সমিতিগুলিকে দখল করে অতীত দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি না করে। 

যদি আবার সেই কোটারী স্বার্থ সমবায়ের পবিত্রতা নষ্ট করে, তবে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন যে আমরা সমস্ত পুরাতন ব্যবস্থা বাতিল করে দেবো। আমার প্রিয় কৃষক, মজুর, জেলে, তাঁতী ভাইদের সাহায্যে এমন একটি নুতন ও সুষম ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা শোষণ ও প্রতিক্রিয়াশীল কোটারী স্বার্থকে চিরদিনের জন্য নস্যাৎ করে দেবে।

বাংলাদেশ সমবায় সংস্থার বিভিন্ন স্তরে বহুবিধ অব্যবস্থা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে জমে জমে দুর্নীতির পাহাড় তৈরী হয়েছে। সমবায় সংস্থা অবাধ বিকাশ ও সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে দুর্নীতির জগদ্দল পাথরকে সরাতেই হবে। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে পরিচালিত প্রশাসন ব্যবস্থাকে দুর্নীতির নাগপাশ থেকে মুক্ত করে জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন, ধ্যান, ধারণা ও আরাধনার ধন। আর সে সোনার বাংলা ঘুমিয়ে আছে চির অবহেলিত গ্রামের আনাচে-কানাচে, চির উপেক্ষিত পল্লীর কন্দরে কন্দরে, বিস্তীর্ণ জলাভূমির আশে পাশে আর সুবিশাল অরণ্যের গভীরে। ভাইয়েরা আমার, আসুন সমবায়ের যাদুস্পর্শে সুপ্ত গ্রাম বাংলাকে জাগিয়ে তুলি। নব-সৃষ্টির উন্মাদনায় আর জীবনের জয়গানে তাকে মুখরিত করি।

আমাদের সংঘবদ্ধ জনশক্তির সমবেত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে ‘সোনার বাংলা’। এ দায়িত্ব সমগ্র জাতির, প্রত্যেক সাধারণ মানুষের এবং তাঁদের প্রতিনিধিদের। তবেই আমার স্বপ্ন সার্থক হবে, সার্থক হবে শহীদের আত্মত্যাগ, সার্থক হবে মাতার অশ্রু। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তার সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পাবে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদে, আপামর জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়নে। তবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে রূপায়িত হবে সমাজতান্ত্রিক নীতির এবং সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাবো সমবায়ের মাধ্যমে। 

জয় বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলন। জয় বাংলা।

এএইচ/