ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ঢাকা সিটি নির্বাচন: রাত পোহালেই ভোট

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ১২:১৯ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার | আপডেট: ১২:৩৭ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২০ শুক্রবার

গত কয়েক দিনে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে। আজ রাত পোহালেই আগামীকাল ভোট।

এখন চলছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভোট গ্রহণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আজ ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে যাবে নির্বাচনী মালামাল। শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে। 

নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। নির্বাচন উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার শেষদিনের প্রচারণা চালিয়েছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।

বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে মূলপ্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন বিএনপির ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন।

এ সিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরও রয়েছেন, জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন। বাকি মেয়র প্রার্থীরা হলেন- গণফ্রন্টের আবদুস সামাদ সুজন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আকতার উজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লা, ইসলামী আন্দোলনের মো. আবদুর রহমান ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) বাহারানে সুলতান বাহার।

অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন বিএনপির তাবিথ আউয়াল। এছাড়াও এ সিটিতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন- কমিউনিস্ট পার্টির ডা. আহাম্মদ সাজেদুল, এনপিপির মো. আনিসুর রহমান দেওয়ান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) শাহীন খান ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ।

দুই সিটির প্রার্থী সংখ্যা

দুই সিটি নির্বাচনে ১৩ মেয়র প্রার্থীসহ কাউন্সিলর পদে প্রায় সাড়ে ৭শ’ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১০ জানুয়ারি প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রচারণায় নামেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা।

ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ৪৭০ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ৩৩৪ জন। বাকি ১৩৬ জনের অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন; আবার যাচাইয়ে অনেকের প্রার্থিতা হয়েছে। বর্তমানে মেয়র পদে ছয়জন, ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডের বিপরীতে ২৫১ কাউন্সিলর ও ১৮টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৭৭ নারী কাউন্সিলর ভোটের মাঠে রয়েছেন।

অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ৪১৬ জন। এ সিটিতে সাতজন মেয়র পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তারা সবাই চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। তবে কমেছে সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা। এ সিটিতে ৭৫টি ওয়ার্ডে ৪৬০ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও চূড়ান্ত লড়াইয়ে রয়েছেন ৩২৭ জন ও সংরক্ষিত ২৫টি ওয়ার্ডে ১০২ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ভোটের মাঠে রয়েছেন ৮২ জন।

ভোটার সংখ্যা

দুই সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর থেকে জানা গেছে, দুই সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২৮ লাখ ৪৩ হাজার আটজন ও নারী ভোটার ২৬ লাখ ২০ হাজার ৪৫৯ জন। 

সিটি করপোরেশনের হিসাবে ঢাকা উত্তর সিটিতে মোট ভোটার ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭ ও নারী ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬ জন। 

অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোটার সংখ্যা ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ ও নারী ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন।

ভোট কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ

ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানান, ঢাকার দুই সিটিতে এবার দুই হাজার ৪৬৮টি ভোটকেন্দ্র ও ১৪ হাজার ৪৪৫টি ভোটকক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে এক হাজার ৩১৮টি ভোটকেন্দ্র ও সাত হাজার ৮৫৭টি ভোটকক্ষ এবং দক্ষিণ সিটিতে এক হাজার ১৫০টি ভোটকেন্দ্র ও ছয় হাজার ৫৮৮টি ভোটকক্ষ রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটিতে ৬৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং দক্ষিণে ৬৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব কেন্দ্র অবস্থিত।

এদিকে ঢাকার দুই সিটিতে মোট ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা রয়েছেন ৪৫ হাজার ৮০৩ জন। এর মধ্যে দুই হাজার ৪৬৮ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ১৪ হাজার ৪৩৪ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ২৮ হাজার ৮৬৮ জন পোলিং কর্মকর্তা রয়েছেন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। 

ঢাকা উত্তর সিটিতে এক হাজার ৩১৮ জন প্রিসাইডিং ও সাত হাজার ৮৫৭ জন সহকারী প্রিসাইডিং ও ১৫ হাজার ৬৯২ জন পোলিং কর্মকর্তা ভোট গ্রহণ করবেন। 

অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এক হাজার ১৫০ জন প্রিসাইডিং, ছয় হাজার ৫৮৮ জন সহকারী প্রিসাইডিং ও ১৩ হাজার ১৭৬ জন পোলিং কর্মকর্তা ভোট নেবেন।

আলোচনায় ইভিএম

ঢাকার দুই সিটিতে প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে যাচ্ছে ইসি। দুই সিটিতে ভোটগ্রহণের জন্য ২৮ হাজার ৮৬৮টি ইভিএম প্রস্তুত করা হয়েছে। ঢাকা উত্তরে ১৫ হাজার ৬৯২টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৩ হাজার ১৭৬টি মেশিন ভোটে থাকবে।

জানা গেছে, ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি সহায়তা দিতে সশস্ত্র বাহিনীর ৫ হাজার ১৫ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে দু’জন করে সার্জেন্ট বা কর্পোরাল বা ল্যান্স-কর্পোরাল অথবা সৈনিক দায়িত্ব পালন করবে। এ ছাড়া ৫২ জন জেসিও ও ২৭ জন অফিসারও মাঠে থাকবেন। ইতিমধ্যে দুই সিটির জন্য ৫ হাজার ৫৩৮ জন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিয়োগের আদেশ হয়েছে।

এই প্রথমবারের মতো সব কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ইসির দাবি, ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, জাল ভোটসহ নির্বাচনের সব অনিয়ম দূর করা সম্ভব হবে। 

কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির সন্দেহ, এই মেশিন ব্যবহারের মাধ্যমেই জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। তাদের অভিযোগ, ইসি ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভোটের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। 

অন্যদিকে ইভিএম নিয়ে আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকে বিতর্কিত করে কমিশনকে হেয় করার চেষ্টা বিএনপি প্রথম দিন থেকেই শুরু করেছে। নির্বাচনে পরাজয় এবং ভোটের মাঠে নির্বাচন বর্জনে তাদের পুরোনো সংস্কৃতি চালু রাখতেই এসব অভিযোগ তুলছে।

তবে বিশ্নেষকদের মতে, ইভিএম ব্যবহারের আগে যথেষ্ট প্রচার হয়নি। তাই এ মেশিন নিয়েও জনমনে বিভ্রান্তি এখনো কাটেনি।

ইভিএম নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ইভিএম নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কার জায়গা রয়েছে। ইসি নিজেই ভুগছে আস্থার সংকটে। তারপরে এই নতুন ব্যবস্থা ভোটারদের কাছে যথেষ্ট পরিচিতি পায়নি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনও মনে করেন, এই ইভিএমের বড় দুর্বলতা ভিভিপিএটি না থাকা। পেপার টেইল না থাকার কারও মনে সন্দেহ জাগলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণেই ইভিএম নিয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক থামছে না।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন ঘিরে থাকছে তিন স্তরের নিরাপত্তাবলয়। এগুলো হল-নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র ও তার আশপাশের এলাকা গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় এসেছে।

নিরাপত্তার প্রথম ধাপে বৃহস্পতিবার থেকেই রাজধানীতে পুলিশের পাশাপাশি ৬৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে অতিরিক্ত আরও ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য।

দুই সিটিতে মোট দুই হাজার ৪৬৮ কেন্দ্রের মধ্যে ১ হাজার ৫৯৭টি কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ। আর সাধারণ কেন্দ্র রয়েছে ৮৭১টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭টি থানা এলাকায় ১৮টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড এবং ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ড রয়েছে।

এসব ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১ হাজার ৩১৮টি। এ ছাড়া ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে ২৫টি থানা এলাকায় ২৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড ছাড়াও ৭৫টি সাধারণ ওয়ার্ডে ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১ হাজার ১৫০টি।

এসব ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আনসার ও পুলিশের ৪২ হাজার ৬৮২ জন সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্য নিয়োজিত থাকবেন।

বিজিবি সদর দফতর জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাদের ৬৫ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন থাকবে। এর মধ্যে ঢাকার উত্তরে ২৭ প্লাটুন আর দক্ষিণে ৩৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থাকবে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পুলিশ, এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের সমন্বয়ে প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি মোবাইল ফোর্স থাকবে।

নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন বিভিন্ন দেশের অন্তত ৬৭ পর্যবেক্ষক।

ইসি সূত্র জানায়, সাতটি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। 

এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ২৭ জন, যুক্তরাজ্যের ১২ জন, সুইজারল্যান্ডের ৬ জন, জাপানের ৫ জন, নেদারল্যান্ডসের ৬ জন, ডেনমার্ক ২ জন, নরওয়ের ৪ জন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫ জন পর্যবেক্ষক সিটি ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন। 

এছাড়া আরও ২২টি দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার ১ হাজার ১৩ জন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের কয়েক হাজার সাংবাদিক ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।

এমবি/