ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ঢাকা সিটির উন্নয়নে অন্তরায় কী?

আজাদুল ইসলাম আদনান 

প্রকাশিত : ০৬:৪৪ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শনিবার | আপডেট: ০৮:২০ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শনিবার

১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে রাজধানীর ঢাকা পৌরসভা থেকে পৌর কর্পোরেশনের মর্যাদা লাভের পর শহরটি দ্রুত বিকাশ লাভ করে। পরিণত হয় ব্যবসার কেন্দ্র বিন্দুতে। সময়ের সাথে সাথে পৌরসভা অঞ্চলও বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে বাড়তে থাকে জনসংখ্যা। ফলে নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বও বেড়ে যায় বহুগুণে। 

পরবর্তী ১৯৯০ সালের দিকে এটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল শহরটির বাসিন্দাদের উন্নত জীবনমান রক্ষা করা। কিন্তু শুরু থেকেই এর কমই দেখেছে নগরবাসী। 

মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে রুপ দিতে ঢাকাকে ২০১১ সালে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নাম দিয়ে আলাদা করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার। 

সরকারের নেয়া এসব উদ্যোগের পরও আজ পর্যন্ত মানসম্মত পরিষেবা অধরাই থেকে গেছে। কেননা, এখন পর্যন্ত নগরবাসী ট্রাফিক জ্যাম ও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি। সে সমস্যা আরো জটিল করে তুলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। 

এমনকি গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচকে সবচেয়ে খারাপ বাসযোগ্য ১০ শহরগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়। 

ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এতকিছুর পরও নগর কর্তৃপক্ষ সাফল্য পাচ্ছে না কেন? এটা কি জনসংখ্যার কারণে হচ্ছে? নাকি গবেষণার সীমাবদ্ধতা? নাকি অন্য কিছু?

অথচ, আমরা যদি আমাদের একেবারে প্রতিবেশী দেশ কলকাতার দিকে নজর দেই, তাহলে দেখতে পাই এমন পদক্ষেপ নিয়েই তারা সফলতা পাচ্ছেন। তারা কলকাতা পৌর কর্পোরেশন আইন, ১৯৮৪-এর অধীনে যাত্রা শুরু করেছিল। ওই সময় কলকাতা অপরিচ্ছন্ন নগর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলানো হত, শহরজুড়ে ছিল লোডশেডিং। ফলে জনজীবন ছিল খুবই নিম্নমানের।   

কিন্তু তারা আজ পরিবর্তন হয়েছে। নতুন ওই আইন কার্যকর হওয়ায় কলকাতা মানসম্মত ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে। রাস্তাগুলোর পাশে নেই কোনো আবর্জনা, প্রতিটি রাস্তায় রাতে মিটমিট করে জ্বলে লাইটের আলো, অধিকাংশ রাস্তায়ই নেই কোনো খানাখন্দ। 

এ থেকেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও পশ্চিবঙ্গের রাজধানীর কলকাতার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় তা স্পষ্ট হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সরকার যখন ঢাকার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলে, প্রশাসন তখন অনেকটা নিশ্চুপ থাকে। একইসঙ্গে ইউটিলিটি পরিষেবা সরবরাহকারীদের এখতিয়ার নিয়ে বিভ্রান্তি সাফল্যের অন্যতম বাধা। 

আমাদের সিটি কর্পোরেশন চার ডজন সরকারি সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মেয়র বাদে অন্যান্য পরিষেবাগুলো পূর্বে বিভিন্ন আইন দ্বারা পরিচালিত হলেও বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। 

সিটি কর্পোরেশন সরকারি সেবা সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জ্বালানি তেল ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার বহির্ভূত। 

ফলে, সংস্থাগুলো তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সামঞ্জস্য করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রায়শই ফল ভোগ করতে হয় নগরবাসীকে। এছাড়াও, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব শহরের উন্নয়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণে বড় বাধা। 

কিন্তু দুই সিটি কর্পোরেশন ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি উভয়ই স্থানীয় সংস্থাগুলোকে পাশ কাটিয়ে কিছু করতে পারে না। অতীতেও মেয়ররা ভাল পরিষেবা দিতে সংস্থাগুলোর অপ্রতুল এখতিয়ার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।  

উদাহরণস্বরূপ, সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য কোনও মাস্টার প্ল্যান করতে বা কোনও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে না, কারণ ওয়াসাসহ কমপক্ষে আরও সাতটি সংস্থা এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। 

তবুও, প্রতিবছর যখনই রাজধানীতে হাটু পানি জমে, তখন সাধারণ মানুষদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয় এই মেয়রদেরই। সব দায় যেন তাদেরই।  

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থা যার জন্য নগরবাসী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এগুলো পর্যবেক্ষণে পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থাগুলো রয়েছে, কিন্তু এগুলোর ব্যর্থতার দায় তারা নেয় না।’

সমন্বয়ের অভাব ছাড়াও বিদ্যমান ব্যবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের সমস্ত কার্যনির্বাহী ক্ষমতা মেয়রদের হাতে। কাউন্সিলরদের কোনো বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার না থাকায় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে - যোগ করেন তিনি। 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংকট উত্তরণে মেট্রোপলিটন সরকারের প্রবর্তন করার সময় হয়েছে। যে ধারণা দিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালের ঢাকার প্রথম মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। 

এমনকি ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত ঢাকার টানা ১০ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করা সাদেক হোসেন খোকাও মহানগর সরকারের ধারণাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। 

যেখানে বলা হয়, মেট্রোপলিটন সরকারের নেতৃত্বে থাকবেন মেয়র। একইসঙ্গে শহর সম্পর্কিত সকল প্রয়োজনীয় সরকারি পরিষেবা এবং উন্নয়ন সংস্থা যেমন ডিএমপি এবং ওয়াসা-এর আওতাধীন থাকবে। 

এছাড়া টেলিফোন, অগ্নিনির্বাপক পরিষেবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, পরিবেশ, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক পরিবার, পরিবার পরিকল্পনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন ইত্যাদি সম্পর্কিত কাজও মহানগর সরকারকে দেওয়া হবে।

কিন্তু ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ হানিফ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিজ দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই কোনও ইতিবাচক সাড়া পাননি। 

একইভাবে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেসয়য় ক্ষমতাসীন বিএনপি থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি সাদেক হোসেন খোকা। ফলে, তাদের সে পরিকল্পনা আজও বাস্তবতার মুখ দেখেনি। তাদের পর পরবর্তীতে আর কোনো মেয়রকে এ ব্যাপারে আগাতে দেখা যায়নি। 

বিশিষ্ট স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মহানগর সরকারের সে ধারণা কার্যকর হচ্ছে না।’

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘রাজধানীর একজন মেয়র একটি ল্যাম্পপোস্টের বাতি পরিবর্তন করতে পারেন কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি একক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।’

প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘যেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি পৃথক পুলিশ ইউনিট থাকতে পারে, সেখানে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব কোনও পুলিশ কেন থাকবে না?’

ট্র্যাফিক পরিস্থিতিও অনুরুপ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিটি মেয়ররা তাদের নিজস্ব পুলিশ না পাওয়া পর্যন্ত বা ট্রাফিক পুলিশ মেয়রের অধীনে না আসা পর্যন্ত নগরীর ট্র্যাফিক জ্যাম থেকে মুক্তি মিলবে না নগরবাসীর।’