ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বিশ্ব জলাভূমি দিবস এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি

মো: রিয়াদুল আহসান নিপু

প্রকাশিত : ১২:২৮ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ রবিবার

পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হল জলাভূমি বা Wetland। ২ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জলাভূমি ও জীব বৈচিত্র্য’।

জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের এইদিনে ইরানের রামসার শহরে অনুষ্ঠিত পরিবেশ বাদী সম্মেলনে জলাভূমির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণ এর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়। যা রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত।  ১৯৭৫ সাল থেকে এই চুক্তি  কার্যকর হয়।

১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। আজ পর্যন্ত ১৭১টি দেশ এটি অনুমোদন করেছে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস হিসেবে IUCN, UNESCO সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, সরকারী ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ১০০টির ও বেশি দেশে পরিবেশ সচেতন নাগরিকগণ পালন করে আসছেন।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সংস্থা UNESCO রামসার কনভেনসন এর সমন্বয়ক এর দায়িত্ব পালন করে আসছে।

বাংলাদেশকে বলা হয় নদী মাতৃক দেশ। নদী-নালা, বিল হাওর, বাওড় এর মত বহু জলাভূমি এদেশকে ঘিরে রেখেছে। বাংলা পিডিয়ার তথ্য মতে- এদেশের ৭-৮ লক্ষ  হেক্টর ভূমি কোন না কোনভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত যা আমাদের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ।

পরিবেশ এর ভারসাম্য রক্ষা, জীব বৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস ও পর্যটন সহ নানা ক্ষেত্রে  এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হল জলাভূমি। এদেশের প্রাকৃতিক স্বাদু পানির মাছের প্রধান উৎস হল হাওর বেসিন অঞ্চল। জীব বৈচিত্র্য এর ক্ষেত্রে এদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হল হাওড় অঞ্চল ও সুন্দরবন। এছাড়া আড়িয়াল বিল ও চলন বিল এদেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি।

পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দরবন সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু সমৃদ্ধ জীব বৈচিত্র্যই নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত সাইক্লোন এর হাত থেকে এদেশকে বাঁচানো এক অতন্দ্র প্রহরী হল সুন্দরবন। সম্প্রতি সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ এর চাহিদা মেটাতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। সুপার ক্রিটিকাল টেকনোলজি ব্যবহার এর কথা বলা হলেও এটি যাতে কোনভাবেই সুন্দরবন এর ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধ জীব বৈচিত্র্য এর আরেক নিদর্শন হল টাংগুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত টাংগুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে এখানে। ২০০০ সালে টাংগুয়ার হাওরকে সুন্দরবন এর পর বাংলাদেশের ২য় 'রামসার সাইট' হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,  কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা জেলায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে।

জীব বৈচিত্র্য সহ খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে এই জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী হাওর বেসিন অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ৫.২৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের প্রাণ এই জলাভূমি তথা নদী, নালা, হাওর এর পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য  সংরক্ষণ এর কোন বিকল্প নেই।  সাংবিধানিক ভাবেও এর গুরুত্ব স্বীকৃত।

বাংলাদেশের সংবিধান এর ১৮ক এর অনুচ্ছেদ এ পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এর কথা বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’। যা সরকারের পরিবেশ বান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

কিন্তু সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশ দুষণ, জনসংখ্যার চাপ সহ নানা কারনে এদেশের জলাভূমি সমুহের প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন। হারিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সহ নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী। বহু জীব বিলুপ্ত হওয়ার আশংকায় রয়েছে। অনেকের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক এখন পর্যন্ত ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশ গত সংকটাপন্ন এলাকা (ECA) বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যার প্রায় সবগুলোই জলাভূমি। এর মাঝে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন, টাংগুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, মারজাত বাওড় এবং পরবর্তীতে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদী ও গুলশান লেককে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এসব অঞ্চলে ক্ষতিকর কারখানা স্থাপন, মাটি পানি বায়ু দুষণকারী কার্যক্রম, মাছসহ জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ এবং যেকোন ধরনের পরিবেশ দুষণ নিষিদ্ধ। যদিও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন।

জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ সহ হাওর অঞ্চলের উন্নয়নে সরকারের ২০১২ সাল থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। অন্যান্য জলাভূমি সংরক্ষণ এর জন্যও পরিকল্পনা রয়েছে।

আয়তনে ছোট হলে বাংলাদেশের রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীব বৈচিত্র্য।  শুধু জীব বৈচিত্র্যই নয় কৃষি, মৎস,পর্যটন এর জন্য টেকসই জলাভূমি ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই।

২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী পালিত হবে। এই মাহেন্দ্রক্ষণ এর আগে বিশ্ব জলাভূমি দিবসে পরিবেশ সচেতন নাগরিকগণ বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে জলাভূমি ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে নতুন করে অনুপ্রাণিত হবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ঢাবি মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
এসএ/