ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

বাংলাদেশে ক্যান্সার নির্ণয়ে সীমাবদ্ধতা কোথায়?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:০৩ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বুধবার

পৃথিবীতে যত প্রাণঘাতী রোগ আছে, ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম। ক্যান্সার বলতে আমরা বুঝি, এক ধরনের ক্ষতিকর টিউমার অথবা অস্বাভাবিক কোষের বংশ বৃদ্ধি, যেটা আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকে। যদি এটাকে দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এক সময় আশেপাশের কোষগুলোতে বা টিস্যুগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে। একসময় এটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে এবং রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।

ক্যান্সারকে যদি খুব দ্রুত শনাক্ত করা যায়, তবে এটাকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং অনেক মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। সে জন্য সারা পৃথিবীতেই বিভিন্ন ধরনের প্রচার প্রকাশনা, বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে সব ধরনের ক্যান্সারকে যেন খুব দ্রুত শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি, এ জন্য বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ৪ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়ে থাকে। 

বিশ্ব ক্যানসার দিবস একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রতি বছর পালিত হয়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হলো। প্রতি বছরই এক একটি স্লোগানকে সামনে রেখে দিবসটি পালিত হয়।

একুশে টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান একুশের রাতে সম্প্রতি ক্যান্সারের কারণ, প্রতিরোধে করণীয় কী, ক্যান্সার শনাক্তকরণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন-  জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (রুম্মান) ও একজন ভুক্তভোগী সাব্বির আহমেদ। ক্যান্সারে তার বাবাকে ১৯৯৫ সালে হারান সাব্বির। তার বাবার মৃত্যুর পর তার মায়ের সম্পর্কে বরডেম হাসপাতাল থেকে ভুল কথা বলা হয় বলে জানান তিনি। 

সাব্বির জানান, তার মায়ের বুকে একটা ছোট টিউমার ছিল। টিউমারটা অপারেশন করল বারডেম। করে বলল, এটার মধ্যে ক্যান্সার আছে। তাকে ক্যামোথেরাপি দিতে হবে, তাকে রেডিও থেরাপি দিতে হবে। এবং একটা কোর্স ডিজাইন করে দিলেন। 

তিনি বলেন, খুবই নাম করা একজন ডাক্তার, যার নাম বলবো না। পরে মাকে নিয়ে গেলাম ভারতে। সেখানকার ডাক্তার দেখে বললেন, বুকে যদি টিউমারের মধ্যে ক্যান্সার থেকে থাকে, তবে বগলের নিচে গ্ল্যান্ডেও ওই ক্যান্সার ছড়াবে। তাহলে গ্ল্যান্ড তো সার্জারি করা হয়নি। তাহলে প্রথম কাজ হচ্ছে- গ্ল্যান্ডটাও ফেলে দেয়া। আর গ্ল্যান্ডটা সার্জারি করতে গিয়ে বায়োপসি করে দেখব, তার মধ্যে ক্যান্সার আছে কি না। থাকলে আমরা সে অনুযায়ী চিকিৎসা করবো। সেই গ্ল্যান্ডে ক্যান্সার পাওয়া গেল না। না পাওয়ায় আমরা অনেক আশ্বস্ত হলাম। ডাক্তার এও বললেন, যদিও পাওয়া যায়নি কিন্তু একবার যেহেতু নির্ণয় করা হয়েছে তোমাদের দেশের বায়োপসি রিপোর্ট বলছে, ক্যান্সার হয়েছে। থেরাপির একটা কোর্স ডিজাইন দেয়া হয়েছে, তাই আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না। তো তারা একটা হরমোন ট্যাবলেট দিলেন। এটা তিন বছর খেতে হবে। তবে এক বছর পর আবার এখানে এসে চেকআপ করতে হবে। যথারীতি পরের বছর গেলাম। এটা ১৯৯৯ সালের কথা। চেক করে পাওয়া গেল না। তাই পরের বছর ডোজটা কমিয়ে দিলেন। পরের বছর আবার গেলাম। তখন বললেন, দুই বছর তো হয়েছে। মনে হয় ক্যান্সার নেই। মা পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে মারা গেছেন। তবে ক্যান্সারে না, অন্য কারণে। পরবর্তীকালে তার একবার বাইপাস সার্জারিও হয়। তাই ক্যান্সার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অবশ্যই ভুল ছিল। কারণ তার মধ্যে পরবর্তীকালে ক্যান্সারের কোনও লক্ষণই আমরা দেখিনি।     

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক ধরনের কথা বলা হয় আবার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যা আমরা প্রায় মনে করে থাকি বাংলাদেশের চেয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো। সেখানে আরেক ধরনের রিপোর্ট দেয় হয়। সেই ৯৩ কিংবা ৯৯ থেকে এখন আমরা ২০২০ এ আছি। এর মধ্যে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে এই নির্ণয়ের ক্ষেত্রে? একুশে টেলিভিশনের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (রুম্মান) বলেন, সাব্বির আহমেদের ঘটনাটা আসলে অনেক দুঃখজনক। এমন অবস্থা কোনও কোনও ক্ষেত্রে যে হচ্ছে না, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। 

তিনি বলেন, তবে এখানে একটা কথা যে, ক্যানসারের চিকিৎসার অত্যাধুনিক রোগ ধরার আমাদের যে ব্যবস্থাপনা, সেটা আমাদের ধীরে ধীরে উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা যদি তুলনা করি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। তারা আজকে যে অবস্থায় এসেছে, তা কিন্তু এক দিনেই আসেনি। সেটা অনেক আগে থেকেই এসেছে। সেখানে একটা সিস্টেম উন্নয়ন হয়েছে। সেখানে একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে সেখানে এমনটা হচ্ছে। এছাড়া, ভারত যেহেতু অনেক বড় একটা দেশ, তাই সেখানে একটা করপোরেট প্রতিষ্ঠান করাও তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। সেখানে রোগীর সংখ্যা বেশি, বিনিয়োগও বেশি। তার জন্য তাদের রোগ শনাক্তকরণের জন্য যে ব্যবস্থাটা, সেটা হচ্ছে অনেক ভালোভাবে সম্ভব। 

তবে একেবারে ধরা পড়ছে না বা আমাদের টেকনিক্যালি সীমাবদ্ধতা-সেটা এক ধরনের কথা। কিন্তু আরেক ধরনের কথা হচ্ছে, ভালোভাবে সেটা নির্ণয় না করেই চিকিৎসায় চলা যাওয়া, এটা তো একজন রোগীর জন্য অনেক বড় একটা ধকল বলা যেতে পারে। এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, এখানে ন্যাশনাল গাইডলাইনও একটা ব্যাপার। ভারতে ৩০ থেকে ৪০ বছর আগে থেকেই ক্যান্সারকে ওরা কীভাবে ফাইট করবে, সেটার জন্য তাদের একটা ন্যাশনাল গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। তারই আলোকে আস্তে আস্তে উন্নয়ন হয়েছে। এজন্য তাদের ভুলের পরিমাণ কমে এসেছে। আর আমাদের এখনও ওই রকম কোনও গাইডলাইন গড়ে উঠেনি। তাই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুটাতে আমাদের অনেক কাজ করা দরকার।

ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান আরও জানান, বাংলাদেশে যে ক্যান্সারগুলো বেশি লক্ষণীয়, সেগুলো হলো- পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, পাস্থলির ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, পায়ু পথের ক্যান্সার ইত্যাদি। আর নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্তন ক্যান্সার, তারপর হচ্ছে, জরায়ু ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, স্টোমাক ক্যান্সার ইত্যাদি। 

তিনি বলেন, অনেক ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই প্রকৃত কারণ উদঘাটন করা কঠিন। কারণ ক্যান্সার হতে অনেকগুলো পর্যায় লাগে। সেক্ষেত্রে যেসব ফেক্টরগুলো প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে, যেমন ধূমপান অনেকগুলো ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তাছাড়া খ্যাদ্যাভাসের একটা ব্যাপার তো রয়েই গেছে। সম্প্রতি যে ডাটা এসেছে, তা হলো- শুধু অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে বিশেষ করে বাংলাদেশে যেটা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে- খাদ্যে ভেজাল। এগুলো ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তাছাড়া আমরা নিয়মিত শরীর চর্চা করছি না, পরিশ্রম করছি না- এ কারণে আমরা অনেক মুটিয়ে যাচ্ছি।

একে//