ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার বিএম কলেজ 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:১৫ পিএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ শনিবার

১৮৫৩ সালে বরিশাল জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে নবজাগরণ শুরু হয় তারই ধারাবাহিকতায় বরিশালের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাবু রমেশচন্দ্র দত্তের অনুরোধে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুন অশ্বিনী কুমার দত্ত তার বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে সত্য, প্রেম, পবিত্রতার মহান আদর্শে ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বি এম স্কুল ক্যাম্পাসে ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করেন।

১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ছিল বি এম কলেজের স্বর্ণযুগ। অধ্যক্ষ ব্রজেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায়, রজনীকান্ত গুহ, বাবু সতীশচন্দ্রসহ সে সময়ের এ কলেজের শিক্ষকগণের পাণ্ডিত্য এবং পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের ঈর্ষণীয় ফলাফল এ শিক্ষকগণের জন্য প্রচুর সুনাম বয়ে আনে। 

এই অধ্যাপকদের প্রজ্ঞা ও শিক্ষা পদ্ধতির উন্নত মান লক্ষ্য করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ ১৯২২ সালে ইংরেজি ও দর্শনে; ১৯২৫ সালে সংস্কৃত ও গণিতে; ১৯২৮ সালে রসায়নে; ১৯৪০ সালে অর্থনীতিতে; এবং ১৯৪৫ সালে ইতিহাসে অনার্স কোর্স চালু করে। তখন এ কলেজে শিক্ষার মান এতটা উন্নত ছিল যে, অনেকে একে বাংলার ‘অক্সফোর্ড’ বলে আখ্যায়িত করেন।

তবে, তখন পর্যন্ত বরিশালে পৃথক কোনো ছাত্র সংগঠন ছিল না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল শিক্ষার্থীরা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই মূলত ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সূচনা ঘটে ঐতিহ্যবাহী এ কলেজে। এখান থেকে বরিশাল অঞ্চেলে স্বাধীকার আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটে। 

৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে ধীরে ধীরে সংঘটিত হতে থাকে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। যার আহ্বায়ক ছিলেন সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। 

ওই কমিটিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী (বিচারপতি), আখতার উদ্দিন আহমেদ, এমডব্লিউ লকিতুল্লাহ, অনিল দাস চৌধুরী, ভোলার শামসুল আলমসহ বৃহত্তর বরিশালের অনেক ভাষাসৈনিক। শুধু তাই নয়, একুশে ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছিলেন বরিশালের অনেক কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পী।

১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রশীদ বিল্ডিংয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় ফজলুল হক হলের ছাত্র ভোলার শামসুল আলমকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয় এবং সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছিলেন বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী। একই দিনে বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউট চত্বরে ছদরুদ্দিনের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এক সভায় বক্তব্য রাখেন আখতারুদ্দিন আহমদ, এসডব্লিউ লকিতুল্লাহ, অনিল দাস চৌধুরী। 

একই দাবিতে অশ্বিনী কুমার হলে আর একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন হাশেম আলী। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত এবং সেক্রেটারিয়েট ঘেরাওয়ের সময় শেখ মুজিবুর রহমান, বরিশালের কাজী গোলাম মাহবুব, সরদার ফজলুল করিম গ্রেফতার হন। 

এসময়ই সর্বপ্রথম বরিশালে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে মিছিলে নামে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ সাধারণ মানুষ। প্রথমবারে  ওই আন্দোলনে পুলিশ হামলা চালায়, নির্যাতনের মুখে ছত্রভঙ্গ হয় শিক্ষার্থীদের ওই মিছিল। ১৪ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। মোহাম্মদ তোয়াহা, কামরুদ্দিন আহমদ ও বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী ছাত্রদের দাবি নিয়ে খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করেন। খাজা নাজিম উদ্দিন ছাত্রদের বাংলাভাষা দাবি মেনে নেন। গ্রেফতারকৃত ছাত্ররা ১৫ মার্চ মুক্তিলাভ করেন। 

পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলে। তারা ১১ মার্চ ভাষা দিবস হিসেবে পালন করত। ১৯৪৯ সালে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এসএম হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেন।

১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বাংলার জনগণ নাজিম উদ্দিনের উক্তির তীব্র সমালোচনা করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

২৮ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম কমিটির সভাপতি হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং আহ্বায়ক হলেন কাজী গোলাম মাহবুব। ২৮ জন সদস্যের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন বরিশালের। তারা হলেন আহ্বায়ক গৌরনদীর কাজী গোলাম মাহবুব-আওয়ামী লীগ, মুজিবুল হক ভিপি-সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, দৌলতখার শামসুল আলম ভিপি-ফজলুল হক হল, পিরোজপুরের শামসুল হক চৌধুরী-ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ, আখতার উদ্দীন আহমদ।

১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুল মালেক খানকে সভাপতি এবং যুবলীগের সম্পাদক আবুল হাশেমকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট ‘বরিশাল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। বরিশাল যুবলীগের সভাপতি আলী আশরাফ ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের অবিসংবাদিত নেতা।

সেসময় বরিশালে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএম কলেজের ছাত্ররা ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশালের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শহরে হরতাল পালিত হয়। ওই দিন ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ বরিশালে পৌঁছালে একজন পুলিশ সদস্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে তা জানান এবং ওই রাতেই সার্কিট হাউজের কাছে অবস্থিত বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউটে সংগ্রাম পরিষদের সভা বসে এবং পরে কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়।

সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ৮১ জনে উন্নীত করা হয়। ‘বরিশাল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র অন্তর্ভুক্ত যারা ছিলেন তাদের কয়েকজন হলেন, আবদুল মালেক খান (সভাপতি, তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের জেলা সভাপতি), আবুল হাশেম (সম্পাদক, যুবলীগ আহ্বায়ক), আলী আশরাফ (সভাপতি, যুবলীগ সদস্য), আবদুল আজিজ তালুকদার, অ্যাডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত, প্রাণকুমার সেন, জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, হাজী আবদুল লতিফ খান প্রমুখ।

ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে হরতাল ও মিছিল হয়। অন্যান্য জায়গার মতো বরিশালেও আন্দোলনকে সংগঠিত করার পেছনে চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রসমাজ। ক্লাস বর্জন করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বরিশাল শহরে। অশ্বিনী কুমার হলের সামনে ভোর থেকে ছাত্র-জনতার স্রোত নামে। গ্রাম থেকে আসা জনতা ছাড়াও শহরের শত শত মহিলা মিসেস হামিদ উদ্দিনের (আওয়ামী লীগ এমপিএ) নেতৃত্বে প্রথম শোভাযাত্রা করেন। 

বরিশালের অন্য মহিলা ভাষাসৈনিক হলেন-হোসনে আরা নিরু, মঞ্জুশ্রী, মাহে নূর বেগম, রানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন মেয়েরা, তার পরে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। স্মরণকালের বৃহত্তর মৌন মিছিল অশ্বিনী কুমার হল থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সার্কিট হাউজ ময়দানে গিয়ে শেষ হয়।

২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় এ কে স্কুল মাঠে শহীদ ছাত্রদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি অশ্বিনী কুমার হলের সামনে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন আবুল হাশেম, জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, চকবাজারের সুলতান, মোশারেফ হোসেন নান্নু, আলী আশরাফ, মোশারেফ হোসেন মোচন প্রমুখ। পুষ্পস্তবক দিয়ে আবুল হাশেম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। অবশ্য ২৭ তারিখ রাতের অন্ধকারে সরকারি নির্দেশে পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। 

ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বরিশালের মানুষের কণ্ঠস্বর ছিল সবসময় জোরাল। ষাটের দশকের নানা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এবং ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে এ অঞ্চলের ছাত্র নেতারা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বরিশাল অঞ্চলের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ অনুভূতি আজও হৃদয়ে ধারণ করে মনেপ্রাণে।। 

এআই/আরকে